শুক্রবার, ৬ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

সোর্সরাই মাদক সাম্রাজ্যের সম্রাট

সাঈদুর রহমান রিমন

সোর্সরাই মাদক সাম্রাজ্যের সম্রাট

ঢাকাজুড়ে গড়ে ওঠা নেশার বাজার কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। রাজধানীর প্রায় এক হাজার স্পটে রাত-দিন চলছে মাদক কেনাবেচা। দুর্ধর্ষ আড়াই সহস্রাধিক ফেরারি আসামি এসব মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করছেন। পুলিশের খাতায় বছরের পর বছর ধরে ‘পলাতক’ এই আসামিরা ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ও মদের স্পট বানিয়ে প্রকাশ্যে বেচাকেনা করছেন। একেকজনের বিরুদ্ধে মাদক বেচাকেনা, চোরাচালান, হত্যা, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসংক্রান্ত ১০-১২টি করে মামলা রয়েছে। মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা পাওয়ায় পুলিশ চিহ্নিত মাদক স্পটগুলোয় অভিযান চালায় না বলে অভিযোগ আছে। তবে চলতি মাসের শুরু থেকেই র‌্যাব সদস্যরা ভাটারা, বাড্ডা, গুলশান, খিলক্ষেতসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে ডাকসাইটে মাদক ব্যবসায়ীরা গাঢাকা দিলেও সোর্স নামধারীদের মাদক বাণিজ্য বহাল তবিয়তেই রয়েছে বলে অভিযোগ।

মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান চলে প্রশাসনের, আটক হন ক্রেতা ও নিরপরাধ পথচারীরা। সোর্সদের মাধ্যমে পথচলা মানুষের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়েও গ্রেফতার-হয়রানির অসংখ্য নজির রয়েছে। তবে বরাবরই মাদকের মূল বেপারিরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বেপারিদের সঙ্গে মাদকের মাসোয়ারা লেনদেনের গোপন সমঝোতায় থানা, পুলিশ, প্রশাসনের দহরম-মহরম সম্পর্ক; তাই গ্রেফতার ও হয়রানিমুক্ত থাকেন তারা।

এদিকে পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্স পরিচয়ধারী ব্যক্তিরাই রাজধানীর দাপুটে মাদক ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এরা মাঝেমধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বী মাদক ব্যবসায়ী দু-চার জনকে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যবসা নিরাপদ রাখেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন টিম ব্যবহার করে সোর্স নামধারীরা প্রতিপক্ষ গ্রুপের মাদক আখড়ায় অভিযান চালান এবং সেখানে জব্দকৃত সিংহভাগ মাদকই নিজেদের হেফাজতে নিয়ে খুচরা বাণিজ্য করেন। বেশ কয়েকটি থানার এসআই-এএসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তার হাত ঘুরেও মাদকের সরবরাহ যায় খুচরা বাজারে। মাদক বাণিজ্যে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে ১৭ পুলিশ সদস্য আটক হয়েছেন, বিভাগীয় শাস্তিও পেয়েছেন অনেকে।

সর্বত্রই দাপট মাদকের : রাজধানীর সর্বত্রই মাদক ব্যবসায়ী আর নেশাখোরদের চলছে দাপুটে ছোটাছুটি। সড়ক-মোড়, অলিগলির মাথায় মাথায় আছে বিক্রেতাদের অবস্থান। মাদক বিক্রেতাদের ভ্রাম্যমাণ টিমও তত্পর আছে নগরীজুড়ে। ক্লাব, জুয়ার আখড়া, সাইবার ক্যাফে, দেহবাণিজ্য কেন্দ্র, বড় বড় শপিং মল, স্টেশন, টার্মিনালকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মাদকের খুচরা বাজার। সাম্প্রতিক সময়ে বনানী থানা এলাকায় মাদকের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। সাততলা বস্তি এলাকায় কামরুল, সীমা, রুবেল, জামাই নাজিমুদ্দিন, সোহেল জমজমাট মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। মহাখালী বাসস্ট্যান্ড পয়েন্টে রিজু, গেন্দাবাবু গড়ে তুলেছেন পাইকারি মাদক সরবরাহের জমজমাট ব্যবসা। বাড্ডার মোল্লাপাড়ায় বাজারগলি ফেনসিডিল ও ইয়াবার বড় স্পট। মাদক আস্তানাটি পরিচালনা করেন মোজাম্মেল, ফর্মা শহিদ, ফর্মা টিপু। কবরস্থান রোডের পাঁচতলা এলাকার বড়টেকে গড়ে তোলা মাদক স্পটটি পরিচালনা করেন সাইফুল, কামরান এবং পাশের অন্য স্পটটি চালান বাঁধন, পল্লব ও ভাগ্নে ফরিদ। বাড্ডার আনন্দনগর এলাকার মসজিদসংলগ্ন গলিতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন জামাই বাছেদ, আলী, চাঁড়াইলা রিপন। আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট ভার্সিটির অদূরে মাদক স্পট পরিচালনা করেন বেল্লাল। স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতার ভাই খোঁড়া মানিক ওরফে দয়াল মানিক এ মাদক আস্তানার মূল হোতা। ভাটারায় ইয়াবা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন হালিম ও তার সিন্ডিকেট। বারিধারার ‘জে’ ব্লক-নয়ানগরজুড়ে মাদকের ছড়াছড়ি। সেখানে দেশি-বিদেশি নামিদামি নানা মদ-বিয়ার থেকে শুরু করে হেরোইন, ইয়াবা, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল— সব ধরনের মাদক পাইকারি ও খুচরা কেনাবেচা চলে হরদম। নয়ানগরে ফেনসিডিল-সম্রাট হিসেবে চিহ্নিত হাজী লিটনের মাদক আখড়া বহাল থাকায় রাত-দিন বহিরাগত যুবকদের আনাগোনায় গোটা এলাকা জনাকীর্ণ থাকছে। সোর্সদের মাদক ব্যবসা চলছেই : মিরপুর ও পল্লবীর অলিগলির মাদক আখড়া সচল রয়েছে। কালশী সাংবাদিকপল্লীর পাশেই কাল্লুর মাদক স্পটটি বেশ রমরমা। কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো ও আশপাশ এলাকার মাদক বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন কেরফা বিল্লাল। ফকিরাপুল গরমপানি গলিতে জাপানি বাবু গড়ে তুলেছেন ইয়াবার পাইকারি বাজার। শান্তিবাগ ঝিল মসজিদ এলাকায় লিটন, সোহেল; আমতলায় উজ্জ্বল, নূরা; শাহজাহানপুর রেলগেট বাজারে মুরগি মাসুম, ইকবাল; শহীদবাগে হোন্ডা মিলনের মাদক বিক্রি থামানোর সাধ্য যেন কারও নেই। মানিকনগরে ২০ জনেরও বেশি মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। তবে এদের বেশির ভাগই ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। তাদের মধ্যে নিজু ও তার স্ত্রী, খাজা, লম্বু মিলন; মুগদায় শরীফ, ডিশ শামীম, হারিসের নাম উল্লেখযোগ্য। নিজেদের সোর্স পরিচয় দিয়েই সূত্রাপুরে মাদক ব্যবসা করছেন সিটি কালাম, রবিন ওরফে জনি, লিটন ওরফে জাবেদ, বাপ্পী, লাল খান, খলিল। রায়েরবাজারে নিমতলী এলাকায় হেরোইন ও ফেনসিডিল সাপ্লাই করছেন জাকির। জয়, দুলাল ও জাহাঙ্গীরকে সঙ্গে নিয়ে জাকির কলাবাগান, ধানমন্ডি লেক, হাতিরপুল, বাংলামোটরসহ গোটা ধানমন্ডি এলাকায় মাদক বিক্রি করেন। হাজারীবাগের ট্যানারি মোড়, কামরাঙ্গীরচর এলাকার মাদক বাণিজ্য চালাচ্ছেন শামীম। যাত্রাবাড়ী বউবাজার এলাকার ফেনসিডিল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন সাইদুল। ধলপুরে ফেনসিডিল স্পট নিয়ন্ত্রণ করছেন এইচ বাবু। সায়েদাবাদ টার্মিনাল এলাকায় ওয়াসার বস্তি, ভিআইপি কাউন্টারের পেছন, আরজু শাহের গলিতে ফেনসিডিল, গাঁজা, বাংলা মদের স্পট নিয়ন্ত্রণ করছেন সালাউদ্দিন এবং তার সহযোগী চান মিয়া ও কালা। শ্যামপুর ও জুরাইনের মাদক বাণিজ্য চালাচ্ছেন ইয়াবা ব্যবসায়ী জুয়েল, আনিছ ও রানা। ধলপুরের ফেনসিডিল বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন সাগর। কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় মাদক রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করছেন মান্নান। ডেমরায় মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন লিটন। এ ছাড়াও সারুলিয়ার ইকবাল, হানিফ, কাটা লিটনের মাদক আখড়া চলে বাধাহীনভাবেই। কারওয়ান বাজারের মোমিন, এবাদুল, মনির, মনোয়ারা ও আবদুল করিম অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী। আলাউদ্দিন ও মাসুদ রানা নিয়ন্ত্রণ করছেন ভাওয়ালবাগ এলাকার মাদক ব্যবসা। মিরপুরের চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা হলেন লাদেন ওরফে বাচ্চু, জট আলী, আবদুল হক, বাবুল ও আলমগীর।

পল্লবী এলাকায় মাদক ব্যবসা করছেন জাহাঙ্গীর, ফজলা ও মনির। সূত্রাপুরের রেললাইন সামাপাড়া বস্তি, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরীক্ষাগার অফিসের পশ্চিম পাশ, কাপ্তান বাজার মুরগিপট্টি, ধূপখোলা মাঠ, মুন্সিরটেক কবরস্থান, যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার ধলপুর সিটি পল্লী, ওয়াসা বস্তি, আইডিয়াল স্কুল গলি, নবুর বস্তি, বউবাজার গলি, লিচুবাগানসহ ২৮ স্পট; শ্যামপুর থানা এলাকার জুরাইন রেলগেট, ব্রাদার্স ক্লাবসংলগ্ন মাঠ, ধোলাইখাল, নোয়াখালী পট্টি, মুরাদপুর মাদ্রাসা লেন, বেলতলা, শ্যামপুর বাজারসহ ৩০ স্পট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর, টিএসসি, তিন নেতার মাজার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশ এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কাঁটাবন এলাকার ভাসমান বিক্রয় স্পট বন্ধ হচ্ছে না কোনোভাবেই।

সর্বশেষ খবর