সোমবার, ৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

পালে হাওয়া বিদ্রোহীদের

দল থেকে বহিষ্কারের পরেও জয় পেয়েছেন ৫ শতাধিক

গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি

পালে হাওয়া বিদ্রোহীদের

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা না পেলেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের পালেও লেগেছে বিজয়ের হাওয়া। দলের বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে গত চার ধাপের ইউপি নির্বাচনে প্রায় ৫ শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মনোনয়ন বাণিজ্য, অযোগ্য প্রার্থী, চিহ্নিত রাজাকার ও তাদের সন্তানদের হাতে নৌকা তুলে দেওয়ায় ধাপে ধাপে বিদ্রোহীদের নির্বাচিত হওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ ধাপেও বিতর্কিত ব্যক্তি, রাজাকার, জামায়াতের সন্তানদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ দুই ধাপেও আরও বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন। 

ইসি সূত্র জানিয়েছে, প্রথম ধাপের স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিদ্রোহী) হিসেবে জয়ী হয়েছেন ১০৯ জন, দ্বিতীয় ধাপে ১১৭ জন, তৃতীয় ধাপে ১৩৯ জন ও চতুর্থ ধাপে ১৬১ জন। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হওয়ায় দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিতরা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ীদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।  

জানা গেছে, চতুর্থ ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নে তৃণমূলের ভোটে জিতেছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খয়বার আলী। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ মো. জাফর আলী তার আপন ভগ্মিপতি আলতাব হোসেনকে ওই ইউনিয়নে নৌকা পেতে চূড়ান্ত সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠান। দলও আলতাব হোসেনকে দলীয় মনোনয়ন দেন। তৃণমূলের ভোটে জিতে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভে আত্মীয়করণকে চ্যালেঞ্জ করে এবং আওয়ামী লীগ বাঁচাতে বিদ্রোহী প্রার্থী হন খয়বর আলী। নির্বাচনের দিন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা শেষ পর্যন্ত খয়বর আলীকেই বেছে নেন। একই অবস্থা জেলার রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নেও। সেখানেও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের আত্মীয় নূর ইসলাম নুরুকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। সেখানে নুরুজ্জামান বুলু যোগ্য প্রার্থী হলেও তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়ী হন। শুধু কুড়িগ্রামই নয়, গত কয়েক ধাপের ইউপি নির্বাচনে দেখা গেছে, দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে প্রার্থী করা, নব্য আওয়ামী লীগার ও চিহ্নিত রাজাকার ও তাদের সন্তানদের হাতে নৌকা তুলে দেওয়ার কারণে নৌকা না পেলেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের পালেই হাওয়া লেগেছে। তারা জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিয়েছেন নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, সিলেট বিভাগে সবচেয়ে বেশি দলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। প্রতিটা ধাপে বিদ্রোহীরাই জয়ী হয়েছেন। সূত্রমতে, দলীয় মনোনয়নে লাখ থেকে কোটি টাকার বাণিজ্যের কারণে অযোগ্য, জনপ্রিয়তাহীন ও ভিন্ন দলের ব্যক্তিরা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। যে কারণে বিদ্রোহীরাই জয়ের মালা পরছেন। চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মাহমুদ আহমদ। তবে এ মনোনয়ন প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না বলে অভিযোগ ছিল তৃণমূল আওয়ামী লীগের। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মাঠে নামেন কবীর আহমেদ। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থী কবীর আহমেদই জয়ী হন। একই অবস্থা বুধবারীবাজার ইউনিয়নে। সেখানে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন হাজী রফিক উদ্দিন। কিন্তু দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়েও শোচনীয় পরাজয় হয়েছে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী কামাল উদ্দিনের কাছে। নীলফামারীর ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়িতে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন মুরাদ আলী প্রামাণিক। সেখানে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হন একরামুল হক। নৌকা না পেলেও শেষ পর্যন্ত জয়ী হন বিদ্রোহী প্রার্থী। উপজেলার সোনারা ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন পান মঞ্জুরুল হক চৌধুরী। তবে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। তাকে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ায় তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন।

চতুর্থ ধাপের ৬৪৯ ইউপির ফল : আওয়ামী লীগ ৪০৫ ও বিএনপি ৭০ : চতুর্থ ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৪০৫ জন ও বিএনপির ৭০ জন জয়ী হয়েছেন। এ ধাপে ৭৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের পাঠানো প্রাথমিক ফলাফলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল ইসির জনসংযাগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান জানান, মাঠ পর্যায়ের পাঠানো ফলাফল একীভূত করে কমিশনের অনুমোদনের জন্য দেওয়া হবে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে এ তথ্য জানানো হবে। দলভিত্তিক ইউপি নির্বাচনে চতুর্থ ধাপে ১৬টি দল অংশ নিলেও বরাবরের মতো এবারও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। চেয়ারম্যান পদে এ ধাপে ৩৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। শনিবার অনুষ্ঠিত ভোটে চেয়ারম্যান পদের ৬৪৯টি ইউপির চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। অনিয়মে ভোটকেন্দ্র বন্ধ হওয়ায় ২০টি ইউপিতে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে পুনরায় ভোটের প্রয়োজন হবে। ইসির পাঠানো ৬৪৯ ইউপির ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ৪০৫ জন, বিএনপির ৭০ জন ও ১৬১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। ৩৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের নিয়ে নৌকা প্রতীকের ৪৪০ জন এ ধাপে বিজয়ী হলেন। জাতীয় পার্টির ১০ জন চেয়ারম্যান এ ধাপে জয়ী হয়েছেন। এক কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৮৫৯ ভোটারের মধ্যে শনিবার ভোট দিয়েছে ৮৯ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪০ জন। সেই হিসাবে ৭৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ ভোট পড়েছে চতুর্থ ধাপে। এবার আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে ৩৯ লাখ ৩৬ হাজার ৯৯৯টি, যা প্রদত্ত ভোটের ৪৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বিএনপি ভোট পেয়েছে ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ভোটের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭২৫টি। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট পেয়েছে ২৯ লাখ ৮৫ হাজার ৭১৫টি, যা প্রদত্ত ভোটের ৩৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।

চার ধাপের ফল : আওয়ামী লীগ ১৮৩৬, বিএনপি ২৪৩ : স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে তৃণমূলের এই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ৭০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। চার হাজারেরও বেশি ইউপির মধ্যে আড়াই হাজারেরও বেশি ইউপির ভোট শেষ হয়েছে।

প্রথম ধাপের চূড়ান্ত ফলে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন ৪৯৪ জন ও বিএনপির ৫০ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ১০৯ ইউপিতে। আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের ৫৪ জন। দ্বিতীয় ধাপে নৌকা প্রতীকের ৪১৯ জন ও ধানের শীষের ৬৩ জন বিজয়ী হন। ১১৭ ইউপিতে জয় পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ ধাপে আওয়ামী লীগের ৩৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তৃতীয় ধাপের ভোটে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন ৩৬৬ জন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ২৯ জন।

 এ ধাপে বিএনপি প্রার্থীরা ৬০টি ইউপিতে জয়ী হয়েছেন; স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ১৩৯ ইউপিতে। চতুর্থ ধাপে নৌকা প্রতীকের ৪০৫ জন জয়ী হয়েছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ৩৫ জন। বিএনপির ৭০ জন ও ১৬১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় পান এ ধাপে। উল্লেখ্য, আগামী ২৮ মে ৭৩৩ ইউপিতে ও ৪ জুন ৭২৪ ইউপির ভোট রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর