শিরোনাম
রবিবার, ১৫ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

নীরব সংকটে গার্মেন্ট শিল্প

জিন্নাতুন নূর

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে বেশ কিছু দৃশ্যমান অগ্রগতি হলেও এখনো এ শিল্পে নীরব সংকট বিরাজ করছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য, কারখানার বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার কাজে এখনো আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। দুর্ঘটনায় আহত পোশাকশ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসাব্যবস্থা চালু হয়নি। এ ছাড়া শ্রম আইনের অপব্যবহার, সংস্কারের জন্য অর্থাভাবে ছোট-মাঝারি কারখানা বন্ধ হওয়া, নতুন কারখানায় গ্যাস সংযোগ না পাওয়ার বিষয়গুলো গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। শ্রমিকনেতারা বলছেন, তৈরি পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করতে হলে আরও কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মালিক-বিদেশি ক্রেতাদেরও আন্তরিক হতে হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এখনো ১ হাজার ১০০ কারখানা পরিদর্শন হয়নি। ভবনের আগুন নিরাপত্তার কাজ তুলনামূলক ভালো হলেও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার কাজে অগ্রগতি হয়নি। শ্রমিকদের তথ্য সংরক্ষণে কারখানাগুলোয় ডাটাবেজ তৈরির কাজেও ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্যদিকে শ্রমিকদের নিরাপত্তায় প্রশিক্ষণের বিষয়টিও কম গুরুত্ব পাচ্ছে। রানা প্লাজাসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা না থাকায় বহু শ্রমিকই দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন। শ্রমিকনেতাদের দাবি, এখনো ৫৩ শতাংশ কারখানা পরিদর্শনের বাইরে। তারা বলেন, কারখানাগুলোয় দৃশ্যমান নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হলেও সেখানে উন্নত কর্মপরিবেশ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। বিশেষ করে শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের চাপ, মাতৃত্বকালীন ছুটি না দেওয়া, রাতে কাজ করতে বাধ্য করা, ১০ দিন উপস্থিত না হলেই ছাঁটাই করা, ক্রেতাদের তৈরি পোশাকের জন্য কম দাম দেওয়া ইত্যাদি বিষয় এখনো গার্মেন্ট শিল্পকে নীরব সংকটের মধ্যে রেখেছে। এ প্রসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাভাবিকভাবে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরির কথা থাকলেও মালিকরা তা করছেন না। কর্মপরিবেশ পুরোপুরি উন্নত না হওয়ায় শ্রমিকরা এখন হয়তো ভবনধসে মরবেন না কিন্তু তিলে তিলে মরবেন। এখনো ট্রেড ইউনিয়ন করতে চাইলে মালিকরা শ্রমিক ছাঁটাই করছেন। এ ছাড়া ক্রেতারা এখনো শ্রমের জন্য কম মূল্য দিয়ে পোশাক কারিগরদের ঠকাচ্ছেন। সে অর্থে ক্রেতারা মুখে যতই বলুক আসলে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে তারা আগ্রহী নন।

গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, রানা প্লাজায় হতাহতরা অনুদান পেলেও এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি। আহতদের জন্য যদি দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেত তবে তারা এখন সুস্থ জীবনে ফিরে যেতেন। এখনো অনেক কারখানা তালাবদ্ধ। এমনকি বহু কারখানার অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলোও মেয়াদোত্তীর্ণ। সে অর্থে নিরাপদ কর্মপরিবেশ বলতে যা বোঝায় তা এখনো গড়ে ওঠেনি।

পোশাক খাত নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারার (২৩, ২৭, ১৮৯, ২(৬)-এর অপব্যবহারের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শ্রম বিধিমালার মাধ্যমে তাদের আহার ও বিশ্রামের সময় কমানো, সীমিতসংখ্যক কারখানায় সেফটি কমিটি গঠন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রতাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি এখনো অবহেলিত।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বিদেশি ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স কারখানা ভবন নিরাপত্তায় বিশেষ করে অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার জন্য এখন কাজ করছে। শ্রম অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১৬ মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ৫৪৯টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়। এর মধ্যে ৩০০ কারখানার ত্রুটি ধরা পড়ে। এর ১৫০টি সংস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়। আর ৩৯টি কারখানা একেবারে বন্ধ, ৪২টি সাময়িকভাবে বন্ধ এবং ৬৯টি বিশেষ সুপারিশের ভিত্তিতে চালু করার অনুমতি পায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারখানা সংস্কারের জন্য ছোট ও মাঝারি কারখানা মালিকদের অর্থ সংগ্রহ করা বেশ কষ্টকর। যদিও অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স ঋণ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) মাধ্যমে কিছু অর্থ সহায়তা করছে। কিন্তু কারখানা মালিকরা বলছেন, এটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশেষ করে ক্ষতি পোষাতে না পেরে ছোট-মাঝারি কারখানা মালিকদের অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। কিছু ছোট কারখানা মালিক সংস্কার ব্যয়সহ নানাবিধ সংকটে পড়ে বড় কারখানা মালিকদের কাছে কারখানা বেচে দিচ্ছেন। আবার কিছু মালিক পোশাক সংগঠনগুলোকে না জানিয়েই দুম করে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। ছোট-মাঝারি উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই ভাড়া বাড়ি বা শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে কারখানা বসিয়ে দীর্ঘদিন অর্ডার নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু শ্রমিকদের নিরাপত্তা ইস্যুতে এখন বিদেশি ক্রেতারাও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে থাকা কারখানাগুলো থেকে পোশাক কিনবেন না। বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে থাকা কারখানাগুলো বেশি ঝুঁকিতে আছে। ক্রেতারা জানিয়েছেন ২০১৮ সালের মধ্যে যদি ভাড়া ভবন থেকে তারা কারখানা সরিয়ে না নেন তবে এসব কারখানাকে আর অর্ডার দেওয়া হবে না।

এ ছাড়া বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে মোট পোশাকের ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি সুবিধাকল্পে ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তির (টিপিপি) ফলে ভিয়েতনাম এখন বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটি বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গ্যাস সংকটের কারণে দেশের পোশাক খাতের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশে মোট গ্যাস সরবরাহের মাত্র ৪ শতাংশ পোশাক খাতে ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে নতুন তৈরি হওয়া পোশাক কারখানাগুলোয় গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদন করা হলেও কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকায় এগুলোয় গ্যাস সংযোগের বিষয় নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। বিশেষজ্ঞ মতে, ২০২১ সালের মধ্যে এ কারখানাগুলোয় গ্যাস সংযোগ দেওয়া না হলে তৈরি পোশাক খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারুক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক খাতের ইমেজ পুনরুদ্ধারে প্রতিটি কারখানা ইন্সপেকশন শুরু করি। ত্রুটি থাকায় ৩৯টি কারখানা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি এ বছরের মধ্যেই শতভাগ কমপ্লায়েন্ট অর্জন করতে পারব। কিন্তু ক্রেতারা যেভাবে আমাদের বলছেন সেভাবে কারখানা সংস্কার করলেও তারা আমাদের পোশাকের দাম বৃদ্ধি করতে অনাগ্রহী।’ তিনি জানান, ‘শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে থাকা কারখানার স্থানান্তর ও গ্যাস সংযোগ নেওয়াই বর্তমানে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ।’

সর্বশেষ খবর