বুধবার, ১৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে বিপন্ন পরিবেশ

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে বিপন্ন পরিবেশ

ভাওয়ালের শালবন দখলে নিয়ে এবং আশপাশের জমি কিনে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে নানা শিল্প-কারখানা। আর এসব শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে গাজীপুরের শালবন এলাকার ২০টি গ্রামে বিপন্ন হয়েছে পরিবেশ। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এখানকার বসবাসরত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। বসবাসকারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন নানা ধরনের চর্মরোগে। এসব কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য শোধনহীন অবস্থায় হোতাপাড়া, ভবানীপুর, বেগমপুর, বাংলাবাজার, বাহাদুরপুর, রাজেন্দ্রপুর, সালনা, বানিয়ারচালা, সিংগারচালাসহ কয়েকটি এলাকার নিম্নাঞ্চলে ফেলে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই বিদ্যালয়ের মাঠ ও শ্রেণিকক্ষ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। এতে বিষাক্ত বর্জ্যের পানিতে হাবুডুবু খেতে হয় স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের। আর এসব থেকে মুক্তি পেতে আশপাশের লোকজন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বারবার সরকারি দফতরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। বৃষ্টি হলেই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে চায় না। কারণ বিষাক্ত বর্জ্যের পানিতে বিদ্যালয়ের আঙিনা সয়লাব থাকে। মাঝেমধ্যে একটু বেশি বৃষ্টি হলে শ্রেণিকক্ষও বিষাক্ত পানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে বিঘ্ন ঘটে পড়াশোনায়। সরেজমিন দেখা গেছে, বাংলাবাজারে অবস্থিত কয়েকটি বেসরকারি কারখানার পশ্চিম পাশের বিস্তীর্ণ জলাশয় এখন স্থায়ী জলাবদ্ধতায় পরিণত হয়েছে। শুধু স্থায়ী জলাবদ্ধতা নয়, বিষাক্ত বর্জ্যে পানির উৎকট গন্ধে এলাকায় বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর একটু পশ্চিমেই বাহাদুরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। উত্তরে রয়েছে গাজীপুর ফিজিক্যাল পাবলিক স্কুল ও কলেজ। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেছে, ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি একেবারেই কম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইব্রাহিম বলেন, আশপাশের কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য বিদ্যালয়ের মাঠ ডুবিয়ে দেয়। এ কারণে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি কম। তিনি বলেন, ‘কী করব, ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস, পরিবেশ অধিদফতরসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র যদিও পরিদর্শনে এসেছিলেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকটি কারখানা রয়েছে এ এলাকায়। এসব কারখানা অপরিকল্পিতভাবে প্রত্যন্ত গ্রামে বনের ভিতর সরকারি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে। কারখানার দূষিত বর্জ্যে সাধারণ মানুষের পেটের পীড়া, আমাশয়, কলেরা, ডায়রিয়ার মতো নানা রোগ এখানে মহামারী আকার ধারণ করেছে। বাহাদুরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ওবায়দুর বলে, ‘বিষাক্ত বর্জ্যের পানি আমাদের স্কুলের আঙিনায় আসে। দুর্গন্ধে স্কুলের ক্লাসরুমে টেকা যায় না। নাক চেপে ধরে ক্লাস করতে হয়।’ একই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সাজিদা বলে, ‘দুর্গন্ধের কারণে আমিসহ অনেকেই এখন স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।’ গাজীপুর ফিজিক্যাল পাবলিক কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আরেফিন জানান, সামান্য বৃষ্টি হলেই কলেজের ভিতর পানি জমে থাকে। আর এসব পানিতে থাকে বিষাক্ত বর্জ্য। পানি গায়ে লাগলে গা চুলকায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গার্মেন্ট, প্লাস্টিক ও কোমল পানীয় কারখানার দূষিত বর্জ্য শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে মানবদেহের চামড়ায় নানা সমস্যা হতে পারে। চর্মরোগ, একজিমা, চুলকানি, দানা দানা গোটাসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে কারখানার দূষিত বর্জ্য ও নিষ্কাশিত পানি মানবদেহে দীর্ঘ সময় লাগলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা হতে পারে। আলসার এমনকি ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, দূষিত বর্জ্য ও নিষ্কাশিত পানি স্থায়ীভাবে মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট করে ফেলতে পারে। শুধু মাটি নয়, সংশ্লিষ্ট এলাকার বায়ু দূষিত হয়ে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে মহামারীতে পরিণত হতে পারে।  দূষিত বর্জ্যের দুর্গন্ধে সাধারণ মানুষ নিঃশ্বাস নিতেও সমস্যায় পড়ে। মানবদেহের নার্ভ ও মেরুদণ্ড স্থায়ীভাবে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর আনজুমানারা বেগম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ফেলে সাধারণ মানুষের বসবাসে ব্যাঘাত ঘটানো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিষাক্ত বর্জ্য এখন স্কুল-কলেজে প্রবেশ করায় বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মো. সবদের মিয়া জানান, বাংলাবাজার এলাকার সব কারখানার বর্জ্যই বাহাদুরপুর বনে নিষ্কাশন করা হয়। এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রতিবাদ করা হলেও কোনো কাজে আসেনি।

পরিবেশ অধিদফতর সূত্র জানায়, অপরিকল্পিত শিল্প-কারখানার লেগুনায় সংরক্ষিত বর্জ্য থেকে দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস চারদিকে ছড়িয়ে বাতাস দূষিত করছে।

অন্যদিকে বিষাক্ত বর্জ্যে অনেক আগেই গাজীপুর জেলার বাংলাবাজার, বাহাদুরপুর, হোতাপাড়া, জাঙ্গালিয়াপাড়া, মণিপুর, ভবানীপুর শিল্প এলাকায় অবস্থিত বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ভূগর্ভস্থ পানিকেও করা হচ্ছে বিষাক্ত। পরিবেশ আইনের কোনো তোয়াক্কা করছে না কারখানাগুলো। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শিল্প-কারখানার মালিকদের ভয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। গাজীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ইজাদুর রহমান মিলন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে বিস্তীর্ণ এলাকার চারপাশের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। এ বিষয়ে যা করণীয় এলাকাবাসী তা করবে।’

সর্বশেষ খবর