বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বনের ভিতর রাতভর চলে জুয়া হাউজি অশ্লীল নৃত্য

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

বনের ভিতর রাতভর চলে জুয়া হাউজি অশ্লীল নৃত্য

ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল রাজার রাজত্ব ছিল গাজীপুর জেলা জুড়ে। দীর্ঘ সময় রাজত্ব করাকালে ভাওয়াল রাজা মাঝেমধ্যে প্রিয় শালবনে ঘুরে বেড়াতেন। আজ সেসব শুধু কল্পকথা হয়ে আছে। ভাওয়াল রাজার সেই প্রিয় শালবন এখন বিলীনের পথে। দিন দিন অসাধু লোকদের খায়েশ মেটাতে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এই ভাওয়াল শালবন। একদিকে বন উজাড় করে জমি দখলে নিয়ে নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল, অন্যদিকে গভীর বনের ভিতর শালগাছ কেটে বিশালাকৃতির প্যান্ডেল বানিয়ে চলছে জুয়া-হাউজি খেলা। দূর থেকে কোনোভাবেই বোঝা যাবে না বনের ভিতর কী হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার সন্নিকটে হওয়ায় অনেকেরই নজর ভাওয়াল শালবনের দিকে। আর এ বনের ভিতর রাতের পর রাত চলে অশ্লীল নৃত্য, জুয়া, হাউজি, অসামাজিক কাজসহ সব ধরনের অপরাধ। এ যেন অপরাধের স্বর্গরাজ্য! আর এসব দেখেও না দেখার ভান করে আছেন ভাওয়াল শালবনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দিনদুপুরে মাইকিং করে জুয়া-হাউজির আয়োজন করা হলেও যেন এসব কানে নেন না সংশ্লিষ্টরা। শুধু তা-ই নয়, সরকারি মালিকানাধীন ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে (ন্যাশনাল পার্ক) চলে এক ধরনের পতিতাবৃত্তি। কতিপয় নামধারী প্রভাবশালী ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক) ইজারা নিয়ে দেদার চালায় এসব অসামাজিক কর্মকাণ্ড। আর এসব কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সালনা, মাস্টারবাড়ী, রাজেন্দ্রপুর, হোতাপাড়া, বাঘেরবাজার, গড়গড়িয়া, মাওনা চৌরাস্তা, জৈনাবাজার এলাকায় প্রায়ই ঘটে ছিনতাইয়ের মতো গুরুতর সব ঘটনা। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ময়মনসিংহ চার লেন মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তার ঠিক পশ্চিম পাশে লাল-নীল বাতি জ্বলছে। আর এসব লাল-নীল বাতি হলো জুয়া-হাউজির সিগনাল। একটু পশ্চিমে গিয়ে দেখা যায় বিশালাকৃতির প্যান্ডেল। হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা দেখে মনে হয় না যে এটি গহিন অরণ্য। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, প্যান্ডেলের পাশে দেখা যায় দামি গাড়ির বহর। আর ভিতরে চলে অশ্লীল নৃত্য, জুয়া, হাউজি খেলা। র‌্যাফেল ড্রর নামে চলে প্রতারণাসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড। অভিযোগ পাওয়া গেছে, পুলিশ, বন বিভাগ ও স্থানীয় সরকারদলীয় নেতাদের টাকা দিয়ে রাতভর চলে এসব অনৈতিক কাজ। জুয়া হাউজির ফলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নানা ফাঁদে পড়ে বিপথগামী হচ্ছে আশপাশের গ্রামের তরুণরা। গ্রামের অনেক কোমলমতি শিশুও ওই ফাঁদে পড়ছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন মহাসড়কের গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া এলাকার পুলিশ ফাঁড়ির ৪০০ গজ দক্ষিণে শালবনের ভিতর অন্তত ১০ বিঘা জমিতে জুয়া-মেলার আয়োজন করা হয়েছে।

জুয়া-মেলার পরিচালক জসীম মিয়া বলেন, ‘পুলিশসহ বিভিন্নজনকে প্রতি রাতে ৫ লাখ টাকা দিয়ে জুয়া-মেলা চালাই।’ অন্যদিকে মহাসড়কের বাঘেরবাজার থেকে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে যাওয়ার সড়কের ৩০০ গজ সামনেই চলছে আরেকটি জুয়া-মেলা। ৬ বিঘা জমি ভাড়া এবং বনের কিছু জমি নিয়ে এই জুয়া-মেলার আয়োজন করা হয়। জমির মালিককে প্রতি রাতে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। শুধু তা-ই নয়, মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা এলাকায় চলছে আরেকটি জুয়া-মেলা, যার একমাত্র মালিক আরিফ মাহমুদ। এখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ৫ বিঘা আর সরকারি বনের জমি ৭ বিঘা। আরিফ হোসেন বলেন, ‘প্রতি রাতে থানা পুলিশ, বনের লোক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে জুয়া-মেলা চলে।’ গ্রামবাসী জানান, গাজীপুর জেলাজুড়ে মাইকিং করে দিনভর র‌্যাফেল ড্রর টিকিট বিক্রি করা হয়। শুধু তা-ই নয়, গাজীপুরের আশপাশের জেলাগুলোতেও মাইকিং করে টিকিট বিক্রি করে আসছে এ অসাধু চক্র। গাজীপুর চৌরাস্তা, রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা, সালনা, মাস্টারবাড়ী, মেম্বারবাড়ী, বাঘেরবাজার, হোতাপাড়া, মাওনা, জয়দেবপুর রেলস্টেশন, রাজেন্দ্রপুর বাজার, শ্রীপুর রেলওয়ে স্টেশন, স্টেশন রোড এলাকার নূরুল ইসলাম খান মার্কেট, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, লোহাগাছ ফালু মার্কেট, কেওয়াবাজার, ভাংনাহাটি, বৈরাগীরচালা, আনসার রোড মোড়, জৈনাবাজার, ময়মনসিংহের ভালুকাসহ অন্তত ৫০টি স্পটে ওই টিকিট বিক্রি করা হয়। টিকিট বিক্রির সময় মাইকের শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন মানুষজন। আশপাশের বিদ্যালয়গুলোতেও পাঠদানে বিঘ্ন ঘটে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্পটে আয়োজকরা নিজস্ব গাড়ি পাঠিয়ে থাকেন খেলায় অংশ গ্রহণকারীদের আনা-নেওয়ার জন্য। মঙ্গলবার রাত ৯টায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তার পশ্চিম পাশে বনের ভিতর বিশাল এলাকাজুড়ে স্থায়ীভাবে তৈরি করা হয়েছে প্যান্ডেল। প্যান্ডেল থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে চৌরাস্তা জামে মসজিদ। রয়েছে একটি মাদ্রাসাও। প্যান্ডেলের ভিতর ঢুকতেই চোখে পড়ে র‌্যাফেল ড্রর ঘোষণামঞ্চ। বাঁ পাশে ওয়ান-টেন, ডাব্বো ও জামাই-বউসহ হরেক জুয়ার ১৩টি স্টল। সব স্টলেই উপচে পড়া ভিড়। ডান পাশেই রঙিন কাপড় দিয়ে ঘেরা হাউজি খেলার ঘর। মেলায় আসা কয়েকজন জানালেন, হাউজির পর এ ঘরেই শুরু হয় নগ্ন নৃত্য। আগত সাধারণের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্যও রয়েছে বনভূমির বিশাল একটি অংশ। সন্ধ্যা হলেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তার দক্ষিণ পাশে আসরের মূল গেটে লাল-সবুজ বাতির ঝলকানি চোখে পড়ে, যা আগতদের আকৃষ্ট করে থাকে। ভিতরে গিয়েই চোখে পড়ে যাত্রা-হাউজির মঞ্চ। রাত ১০টা থেকে শুরু হয় জুয়া খেলা। আগতদের আকর্ষণে বলা হয়, কলতি, টু অ্যান্ড থ্রি—টোয়েন্টি-থ্রি, বিশ্বসুন্দরী—এইটি থ্রি, দাদুর ঘরে চোর—এইটটি ফোর, জ্যাম অ্যান্ড ড্রাইভ—নাম্বার ফাইভ, অফিশিয়াল টাইম—নাম্বার নাইন, লাভ ইজ হেভেন—টোয়েন্টি সেভেন। হাউজি মঞ্চের পাশেই ওয়ান-টেন বোর্ড বসিয়ে চলছে লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা। জুয়ার স্টল ঘুরে দেখা গেল, খেলায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগই তরুণ। টাকা দ্বিগুণ করার প্রলোভনে পড়ে তারা জুয়ার বোর্ডে টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। পাশের জৈনাবাজার এলাকার তরুণ সাব্বির হোসেন জানালেন, মেলা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই তিনি জুয়া খেলায় অংশ নিচ্ছেন। প্রথম দিন ২ হাজার ৩০০ টাকা লাভ হলেও পরে ছয় দিনে প্রায় ৪১ হাজার টাকা খুইয়েছেন। ওই ছয় দিনে প্রতিদিনই তিনি সর্বস্ব খুইয়ে জুয়া-মেলায় আসবেন না বলে পণ করলেও ‘ভাগ্য খুলতে’ পারে ভেবে ফের এসেছেন। রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা মাঠের জুয়ার আসরের মালিক আরিফ মাহমুদ বলেন, ‘প্রতিদিন ৫ লাখ টাকা প্রশাসনকে দিয়ে আমরা ব্যবসা করছি। মাঝেমধ্যে টাকা দিতে দেরি হলে প্রশাসন ক্ষুব্ধ হয়। তা আবার ম্যানেজ করে নিই।’ হোতাপাড়া প্যান্ডেলের মালিক ফারুক হোসেন জুয়ার আসরের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা তো সবার সঙ্গে সমন্বয় করেই এটি পরিচালনা করছি। এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে ইউএনও, ডিসি, এসপি, ওসিদের সুবিধা দিয়ে থাকি। শুধু তা-ই নয়, এলাকার আওয়ামী লীগ, বিএনপি নেতাদেরও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।’ গাজীপুরের দায়িত্বরত পুলিশ সুপার (এসপি) মো. দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নৃত্য ও জুয়ার আসরের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তবে এখন যেহেতু জানতে পেরেছি, এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর