শনিবার, ২৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

সুইফট হ্যাকিংয়ে নেপথ্যে কারা?

হ্যাকারদের নিয়ে তদন্ত চলছে দেশে দেশে

আলী রিয়াজ

সুইফট সিস্টেম হ্যাক করে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি গোষ্ঠী। খুবই সতর্কতার সঙ্গে সাইবার সিস্টেম আক্রমণ করে এ কাজটি করা হচ্ছে। কারা করছে এই হ্যাকিং? বিশ্বের ব্যাংকগুলোর ঘুম হারাম করা হ্যাকিংয়ের নেপথ্যে আসলে কারা? এত বড় আর্থিক জালিয়াতির উৎস খুঁজে পাচ্ছে না বিশ্বের বড় বড় গোয়েন্দা সংস্থাও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ছাড়াও ইন্টারপোল, ফায়ারআইসহ সাইবার বিশেষজ্ঞরাও হ্যাকারদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না।

বেলজিয়ামভিত্তিক সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) বিশ্বের ১১ হাজার ব্যাংকের আন্তর্জাতিক অনলাইন লেনদেনে সাইবার সহায়তা দিয়ে থাকে। এই ১১ হাজার ব্যাংকের সব ধরনের আন্তদেশীয় লেনদেন পুরোপুরি অনলাইনে সম্পন্ন হয়। সাইবার আক্রমণের কারণে ১১ হাজার ব্যাংকের নিরাপত্তা এখন হুমকিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনার পর বার বার সুইফটের দুর্বলতার কথা বলা হলেও বিষয়টি তারা অস্বীকার করছে। যদিও সম্প্রতি সুইফট কর্তৃপক্ষ নিজেদের সিস্টেমে নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়িয়েছে। অনেকের সন্দেহ সুইফটের সাবেক কোনো প্রকৌশলী জড়িত থাকতে পারে হ্যাকিংয়ে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সনি পিকচার্সে সাইবার হামলায়ও উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে এফবিআই ধারণা করছে। দেশটির বেসরকারি সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্থা ফায়ারআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্কে ঢুকে অর্থ চুরির সঙ্গে পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও আরেকটি দেশের হ্যাকারদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে হ্যাকারদের সম্পর্কে বিস্তারিত উৎস বা পরিচয় বের করতে পারেনি তারা। তাদের ধারণা, অজানা তৃতীয় কোনো পক্ষ সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক কিংবা কোনো দেশের এজেন্টও হতে পারে। এতে এসব দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতাও থাকতে পারে।ফায়ারআইয়ের তদন্তে জানা গেছে, অ্যানোনিমাস নামে হ্যাকারদের একটি গ্রুপ বিশ্বের প্রায় ১০ লাখ কম্পিউটারের ম্যালওয়ার স্থাপন করেছে। এ গ্রুপটিই ব্যাংকের অর্থ সুইফট সিস্টেমে ঢুকে হ্যাকিং করছে। অ্যানোনিমাস চক্রটিকে চিহ্নিত করতে ইন্টারপোলসহ একাধিক দেশের গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু হ্যাকারদের কর্মকাণ্ড এত বিস্তৃত যে কোনোভাবেই শনাক্ত করা যাচ্ছে না। হ্যাকাররা অর্থ চুরি করে একাধিক দেশে পাচার করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির পর তার একটি অংশ শ্রীলঙ্কায় আরেকটি অংশ হংকংয়ে পাচার করা হয়। ইকুয়েডরের ব্যাংকের অর্থ চুরি করে হংকং ও দুবাইতে পাচার করা হয়। এসব দেশের যে ব্যক্তিদের কাছে অর্থ গেছে তাদের সব কাগজপত্রই ছিল ভুয়া। ফলে কাউকেই চিহ্নিত করতে পারেনি তারা। প্রতিটি হ্যাকিংয়ে একেক পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। অর্থ পাচারে বেছে নেওয়া দেশগুলোর তালিকায় তুরস্ক, মিসর, দুবাইও রয়েছে। এসব দেশের অনেক হ্যাকার জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে চীন ও হংকংয়ের হ্যাকারদের জড়িত থাকারও প্রমাণ রয়েছে। হ্যাকিংয়ের সঙ্গে কয়েকটি ব্যাংকের নামও এসেছে। এর মধ্যে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন, জাপানের নাগরিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এক কর্মকর্তার নাম রয়েছে। হ্যাকারদের নেটওয়ার্কে ব্যাংকার থেকে শুরু করে দক্ষ টেকনিশিয়ান, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের নাম এসেছে। হ্যাকিংয়ের প্রতিটি ধাপে একেক গ্রুপ কাজ করে। ফলে নেপথ্যে জড়িতদের চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি ভারতের একটি ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে ২৫ বিলিয়ন ডলার হ্যাকিংয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থ চুরির আগেই বিষয়টি ধরা পড়ে। ফিনিশ ফিশার নামে আরেকটি হ্যাকার গ্রুপ ১১ হাজার ডলার চুরি করে সিরিয়ার অ্যান্টি আইএস গ্রুপকে সহায়তা হিসেবে দিয়েছে। রাশিয়া ও তুরস্কের কোনো গ্রুপ এ কাজ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফায়ারআই আরও ১২টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমে আক্রমণের প্রমাণ পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও পূর্ব তিমুর। এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও তিনটি দেশ রয়েছে। ফায়ারআইয়ের কর্মকর্তা মার্শাল হেইম্যান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘কারা সুইফট সিস্টেমে আক্রমণ করছে তা বের করা খুবই কঠিন। কোথা থেকে বা কোন কম্পিউটার ব্যবহার করে হ্যাকাররা ম্যালওয়্যার স্থাপন করে তা বের করা যায়নি। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশে ম্যালওয়্যার সফটওয়্যার স্থাপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু ওই দেশটির কারা জড়িত তা বের করা সম্ভব হয়নি।’ সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক আরেকটি প্রতিষ্ঠান বিএই বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট হামলায় যে কম্পিউটার কোড ব্যবহৃত হয়েছে একই কোড সনি পিকচার্সের হ্যাকিংয়ে ব্যবহার হয়েছে। তবে তারা দুটি কোডই মুছে দিয়েছে। এটি কোনো দেশের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছাড়া করা সম্ভব নয়। ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নেস্তার এসপেনিলা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোনো দেশের ব্যাংকই এখন হ্যাকারদের আক্রমণের বাইরে নয়। কিন্তু হ্যাকারদের চিহ্নিত করার কোনো উপায় নেই। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগ নিতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর