শনিবার, ৬ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

যানজটের নেপথ্যে চাঁদাবাজি

পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে গাড়িপ্রতি চাঁদা সর্বনিম্ন ৬০০ টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটে অতিষ্ঠ মানুষ। এ যানজট বেড়েই চলেছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর নেপথ্যে কাজ করছে পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজি। গুটি কয়েক ট্রাফিক পুলিশের মাধ্যমে এ কারবারই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য দায়ী। ভুক্তভোগীদের মতে, যানজটের কারণে মানুষের কর্মঘণ্টা যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তারা এই যানজটের কারণ হিসেবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশের খামখেয়ালিপনাকেই দায়ী করছেন। তাদের অভিযোগ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশের নৈতিকতা ও সচেতনতা সৃষ্টি না হলে কোনো দিনই যানজট সমস্যার শতভাগ সমাধান করা সম্ভব হবে না। পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, পুলিশের চাঁদাবাজির কারণে চালকরা যেখানে-সেখানে গাড়ি থামানোর সুযোগ পাচ্ছেন। ট্রাফিক আইন ভাঙার অপরাধেও তারা মামলার ঝামেলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন। পুলিশসহ বিভিন্ন প্রভাবশালীকে দিন শেষে তারা সর্বনিম্ন ৬০০ টাকা করে গাড়িপ্রতি চাঁদা তুলে দিচ্ছেন। তা ছাড়া শ্রমিকরা পরিবহন চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হলেও মালিকের টার্গেট পূরণ করতে স্টপেজ ছাড়াই গাড়ি থামিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে যাত্রী তুলতে বাধ্য হচ্ছেন।

একাধিক পরিবহন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহানগরে চলাচলকারী নির্ধারিত রুটের শুরুর পয়েন্টে এবং শেষের পয়েন্টে দিন শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা পুলিশকে দিতে হয়। এ কারণে বেশকিছু সুবিধা তারা পাচ্ছেন। যেমন পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ যেখানে-সেখানে গাড়ি থামানো নিষেধ কিংবা গাড়ি থামালেই দণ্ড লেখা সাইনবোর্ড থাকা সত্ত্বেও সেসব জায়গায় হরহামেশা যাত্রী ওঠা-নামা করাতে পারছেন। চাঁদার কারণেই এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও পুলিশ নীরবতা পালন করছে। পুলিশের এরকম ঢিলেঢালা এবং গা-ছাড়া ভাবের কারণে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি থামিয়ে যাত্রীর জন্য হাঁক-ডাকও করা যাচ্ছে। এসব বিষয়ে জানতে কথা হয় জাকির নামের তুরাগ পরিবহনের এক কন্ডাক্টরের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা যাত্রাবাড়ী থেকে আবদুল্লাহপুর রুটে গাড়ি চালাই। এই রুটের তুরাগের অন্তত ৬০-৭০টা গাড়ি আছে। সবগুলোকে দিন শেষে রুটের দুই প্রান্তেই থাকা মালিক সমিতিতে ৬০০ টাকা করে জমা দিতে হয়। আর ওই টাকা এক জায়গায় জমা করে চার ভাগ করে যাত্রবাড়ী থানা, উত্তরা পশ্চিম ও পূর্ব থানা, শ্রমিক নেতা, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, শুধু তুরাগ পরিবহনই নয়। মেট্রো সার্ভিসে থাকা ছালছাবিল, অনাবিল, সুপ্রভাত, শিকড়, শিখর, বিহঙ্গ, ইউনাইটেড, তানজিল ও ৮ নম্বর লোকালকে বিভিন্ন সেক্টরে চাঁদা দিতে হয়। বিভিন্ন রুটের চাঁদা দেওয়ার পদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের। কোথাও কোথাও দৈনিক, আবার কোথাও সাপ্তাহিক এবং মাসিক হিসাবে নির্ধারণ করা আছে। বিনিময়ে তারা দিয়ে থাকেন বাড়তি কিছু সুবিধা।

এক অনুসন্ধানে আরও ধারণা পাওয়া গেছে, তিন রাস্তা ও চার রাস্তার ক্রসিং পয়েন্টগুলো যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। সব ক্রসিং পয়েন্টগুলোতে, ক্রসিং পয়েন্টমুখী সব রাস্তায় গাড়ি জমে যানজটের সৃষ্টি করছে। পরিকল্পিত বাসস্ট্যান্ড এবং কঠোর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় রাস্তার মাঝখান এবং পাশে যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করা হচ্ছে। শহরের ভিতরে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থাকাও যানজটের একটি কারণ। এ ছাড়া রাস্তার ডিভাইডারের মাঝে ফাঁকা স্থান দিয়ে পিক আওয়ারে গাড়িকে ইউটার্ন করতে দেওয়া, প্রধান প্রধান সড়কগুলোয় দ্রুতগতির বাস, ট্রাক ও প্রাইভেট কারের পাশাপাশি অত্যন্ত কম গতির রিকশা-ভ্যান-ঠেলাগাড়ি ও অটোরিকশা চলার সুযোগ দেওয়া, বহুতলবিশিষ্ট বিপণিবিতান ও অফিসপাড়ার রাস্তার ওপর গাড়ি পার্কিং করতে দেওয়া, ট্রাফিক আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা, ভিআইপিদের যাতায়াতের সময় বিভিন্ন রুটে গাড়ি চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা ইত্যাদি কারণে যানজটের ঘটনা ঘটছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যেসব ক্রসিংয়ে যানজটের কারণে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন সেসব স্থানগুলো হলো— গুলিস্তান, মতিঝিল, দৈনিক বাংলার মোড়, পল্টন মোড়, কাকরাইল মোড়, কাকরাইল মসজিদ ক্রসিং, কদম ফোয়ারা চত্বর, মত্স্য ভবন চৌরাস্তা, শাহবাগ চৌরাস্তা, রূপসী বাংলা হোটেল তিন রাস্তার মোড়, বাংলামোটর চৌরাস্তা, কারওরান বাজার মোড়, ফকিরাপুল চৌরাস্তা, আরামবাগ পুলিশবক্স তিন রাস্তার মোড়, কমলাপুর রেলস্টেশন তিন রাস্তার মোড়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স শাহজাহানপুর চৌরাস্তা, মালিবাগ চৌরাস্তা, শান্তিনগর চৌরাস্তা, মৌচাক মার্কেটের সামনের তিন রাস্তার মোড়, মালিবাগ রেলক্রসিং তিন রাস্তার মোড়, চৌধুরীপাড়া তিন রাস্তার মোড়, মগবাজার চৌরাস্তা, এফডিসির সামনের চৌরাস্তা, ফার্মগেট, খামারবাড়ী, বিজয় সরণির বিমান চত্বর, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র তিন রাস্তার মোড়,  সাবেক র্যাংগস ভবন চৌরাস্তা মোড়, পান্থপথ গ্রিনরোড মোড়, ধানমন্ডি-৩২ শেখ রাসেল স্কোয়ার, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, নীলক্ষেত মোড়, কাঁটাবন মোড়, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, ধোলাইরপাড় তিন রাস্তার মোড়, সায়েদাবাদ তিন রাস্তার মোড়, গোলাপবাগ মাঠ জনপথ মোড়। অভিযোগ রয়েছে, বেশির ভাগ ফুটওভার ব্রিজের অপব্যবহার হচ্ছে শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে। ফুটওভার ব্রিজগুলোর ওপর দিয়ে যাতায়াত বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হয়নি এখনো। আর ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টির আরেকটি কারণ চৌরাস্তার মোড়ের সংখ্যা বেশি থাকা। মহানগরে চলাচলকারী পুরনো বাসগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যানজট সৃষ্টি করে থাকে। এছাড়াও গ্যাস নিতে সময় বেঁধে দেওয়ায় সিএনজি পাম্পগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন মূল রাস্তা পর্যন্ত এসে তা দখল করে রাখে। ফলে অন্যান্য চলাচল গাড়ির যাত্রীদের পোহাতে হয় দুর্ভোগ। এ ছাড়াও ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি ছাড়তে বা থামাতে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম। বিভিন্ন ক্রসিংয়ে যেন গাড়ি থামা আর চলাচল করে ট্রাফিক পুলিশের মর্জি অনুযায়ী।

যানজট নিরসনের সাধারণ মানুষের ভাষ্য, বর্তমানের ট্রাফিক সিগনাল পদ্ধতিতে ক্রসিং পয়েন্টগুলোতে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে হবে। ওয়ানওয়ে ও ওভারপাস পদ্ধতিতে সব ক্রসিং পয়েন্টগুলো ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বিনা বাধায় গাড়ি চলাচল করার সুযোগ দিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সবার আগে আমাদের অবৈধ গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। যানজটের একটি কারণ হলো যত্রতত্র ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল। মেট্রো সার্ভিসে সিটিং নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হচ্ছে না। ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ যাত্রী যেতে পারেন তাদের নিজ গন্তব্যে। অন্যদের নির্ভর করতে হয় লোকাল বাসগুলোর ওপর। আর এই লোকাল বাসের আধিক্যতা এবং ট্রাফিক পুলিশের নীরব ভূমিকায় সেগুলো যেখানে-সেখানে থামছে, কোনো ধরনের লেন মানছে না। এসবের জন্যই সৃষ্টি হয় যানজট। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী শিফান নেওয়াজ বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের রাস্তাগুলো অপর্যাপ্ত এবং অপরিকল্পিত। একই সঙ্গে এতে রয়েছে ট্রাফিকের মিস ম্যানেজমেন্ট। আর যখন দেখা যায় একটি রুটে একাধিক কোম্পানির গাড়ি চলছে, তখন সেখানে দুটি বাসের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কেউ কাউকে জায়গা দিতে চায় না। এতে করে যেন নিরাপত্তা হুমকি থাকে তেমনি পেছনের গাড়িগুলোও আটকে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে।

সর্বশেষ খবর