মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

আর্সেনিক ঝুঁকিতে ২ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ

আহমদ সেলিম রেজা

জনগণের কাছে আর্সেনিক মুক্ত বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দেওয়ার জন্য এক হাজার ৯৬৬ কোটি ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ২০২০ সালের মধ্যে আর্সেনিক ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত রিপোর্টে দাবি করা হয়, দেশের আর্সেনিক পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে সরকারের সঠিক ধারণা নেই। কারণ ২০০৩ সালের পর এ বিষয়ে আর কোনো জরিপ হয়নি। তবে সরকার স্বীকার করেছে মোট জনসংখ্যার ১২ ভাগ মানুষ আর্সেনিক দূষিত পানি পান করছে। জনসংখ্যা ১৬ কোটি হলে দেশে দুই কোটি ৫৬ লাখ মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে গবেষক রিচার্ড পেয়ার্সহাউস এক গবেষণায় দাবি করেছেন, ‘সমস্যার সমাধানে সরকার যদি তত্পর না হয় বা আন্তর্জাতিক দাতারা যদি সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়; তবে দেশটির লাখ লাখ মানুষ আর্সেনিক সংক্রান্ত রোগে মারা যাবে।’ ২০১২ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে জেলাভিত্তিক তালিকা দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, আর্সেনিকজনিত কারণে বাংলাদেশে মৃত্যু ঘটেছে ৪২ হাজার ৭১৭ জন। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী (এলজিআরডি) খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দেশে বর্তমানে ১২ শতাংশ মানুষ আর্সেনিক দূষণজনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে সরকার আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসনে এক হাজার ৯৬৬ কোটি ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে সারা দেশে আর্সেনেক দূষণের বর্তমান পরিস্থিতি জানা যাবে। তিনি আরও জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ২০০৩ সালে সারা দেশের ২৭১ উপজেলায় ৫০ লাখ নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করেছিল, যার মধ্যে ২৯ ভাগ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত (৫০ পিপিবি এর ওপরে) আর্সেনিক পাওয়া গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জনগণের জন্য আর্সেনিকমুক্ত নিরাপদ পানি নিশ্চিত হবে। সদ্য সমাপ্ত বাজেট অধিবেশনে লিখিত প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী সংসদকে এসব তথ্য জানান। এ সময় তিনি আর্সেনিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জনগণকে রক্ষার জন্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের কথাও উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে, ২০০টির অধিক গ্রামকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের আওতায় আনা। এ ছাড়া বিগত ১৫ বছরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের মাধ্যমে আর্সেনিক সঙ্কুল এলাকায় ২ লাখ ১০ হাজার পানির উৎস স্থাপন করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্র জানায়, বাংলাদেশে নিরাপদ পানির উৎস হলো গভীর বা অগভীর নলকূপের পানি। বর্তমানে দেশে নলকূপ রয়েছে প্রায় এক কোটি। এর মধ্যে ৭৮ শতাংশ অগভীর, ১৮ শতাংশ গভীর নলকূপ। সুপেয় পানির অন্য উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টসহ অন্যান্য পদ্ধতি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে এসব নলকূপের পানিও সব সময় নিরাপদ নয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন এলাকার মাটির গুণাগুণ ভিন্ন হওয়ার কারণে এবং অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে এখন মাটির নিচেও অক্সিজেন প্রবেশ করছে। এতে পানিবাহী শিলাস্তরের আর্সেনিক জারিত হয়ে তরল অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানিকে আর্সেনিক যুক্ত করে দিচ্ছে। ফলে নলকূপের পানি থেকেও উঠে আসছে আর্সেনিক নামক বিষ। এছাড়া গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দেওয়া ফসলি জমিতে আর্সেনিকের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বিভিন্ন ফসলে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ৪০ গুণেরও বেশি আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি লিটার পানিতে এক পিপিএম পর্যন্ত আর্সেনিক সহনীয়। কিন্তু এর মাত্রা যদি ৫০ পিপিএম হয় তা হলে সেই পানি পান করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। গবেষণায় দাবি করা হয়, অন্যান্য খনিজ পদার্থের মতো আর্সেনিকও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য সামান্য পরিমাণ প্রয়োজন। আর এই সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক প্রতিদিন শাক-সবজিসহ বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ জাতীয় খাবারের মাধ্যমে আমরা গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু সহনীয় মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় আর্সেনিক মানুষের শরীরে গ্রহণ করার ফলে লিভার, কিডনি ও ফুসফুসে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৬ এপ্রিল ‘স্বজনপ্রীতি এবং অবহেলা : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের খাবার পানিতে আর্সেনিক প্রতিরোধে ব্যর্থ প্রচেষ্টা’ শিরোনামের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়। এতে কয়েক কোটি মানুষ ক্যান্সার, ত্বকের ক্ষয়, হৃদরোগ ও ফুসফুসের জটিলতায় আক্রান্ত হবে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়।

পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার অগভীর নলকূপ স্থাপনের কর্মসূচির পাশাপাশি জলাধার নির্মাণ বা পুকুরের পানিকে সুপেয় করে জনগণের কাছে সরবরাহ করতে চাইছে । এ জন্য সারা দেশে ২০০ পুকুর খনন করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এসব পুকুর খনন শেষ হবে বলে জানিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। একই সূত্র আরও জানায়, প্রতি বছর সারা দেশে নতুন করে ৩০ হাজার নলকূপ বসানো হচ্ছে। কিন্তু এমপি-মন্ত্রীদের চাহিদা ৫০ হাজারেরও বেশি। বিশেষ করে খরা মৌসুমে নলকূপ পেতে মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশের স্তূপ জমে যায়। এ ছাড়া স্থানীয় প্রতিনিধি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের চাপে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা নলকূপ বিতরণের সময় আর্সেনিক এলাকা বাছাই করার সুযোগ থাকে না। ফলে মাটিতে আর্সেনিকের গুণাগুণের কথা চিন্তা না করেই নলকূপ বসাতে হয়। এতে কিছু মানুষ নিরাপদ পানি পেলেও অসংখ্য সাধারণ মানুষ এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে মাটির আর্সেনিক পরীক্ষা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নলকূপ বিতরণ ও জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি তদারকির আওতায় আনার দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর