বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাবা-মা কেন সন্তানের খুনি

বাড়ছে সামাজিক অপরাধ

মাহবুব মমতাজী

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় অনিরাপদ হয়ে পড়েছে শিশুদের বেঁচে থাকা আর তাদের বড় হওয়ার স্বপ্ন। সামাজিকভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগে প্রাকৃতিকভাবে সব সন্তানই তার নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেয় নিজ মায়ের কোল। কিন্তু সেই অতি আপনজন দরদি মায়ের হাতেই নির্মমভাবে খুন হচ্ছে সন্তান। এমন কয়েকটি ধারাবাহিক ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাবার হাতেও নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় তারা। আর বেশির ভাগ শিশু পারিবারিক কলহ, অনৈতিক সম্পর্ক, শত্রুতা, অপহরণ, ধর্ষণ, রাজনৈতিক সংঘাত এবং জমি-জমার দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয়েছে। কেন বাবা-মার হাতে সন্তান খুন হয়-তা জানার কৌতূহল রয়েছে সচেতন মহলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন-ডিসপ্লেসমেন্ট অব এনগার অর্থাৎ নিজের রাগকে অন্য কারও ওপর স্থানান্তরের কারণে এসব ঘটতে পারে। এর জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথ কাউন্সিলিং করতে হবে এবং তা বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চলতি বছরের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট ১৬০ জন শিশু খুন হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারি মাসে ২৯ জন। তাদের ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পারিবারিক কলহ, অনৈতিক সম্পর্ক, শত্রুতা, অপহূত, ধর্ষণ, রাজনৈতিক সংঘাত, দাম্পত্য কলহ, মানসিক যন্ত্রণা, হতাশা এবং জমি-জমার দ্বন্দ্বের কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বিশ্লেষণে তারা আরও কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে— ২০১৫ সালে অপহরণের পর ৪০ জন শিশু খুন হয়, নিখোঁজের পর ৬৭ জন শিশুর লাশ পাওয়া যায়, ধর্ষণের পর ৩০ জনকে হত্যা করা হয়, আর নিজের বাবা-মার দ্বারা খুন হয় ৪০ জন শিশু, ১৪ জন শিশু খুন হয়েছে দুর্বৃত্তদের দ্বারা এবং ৯ জন শিশু খুন হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হয়ে। আর গত দুই বছরে শুধু বাবা-মার হাতেই খুন হয়েছে অন্তত ৯০ জন শিশু। সূত্র জানায়, গত ১৯ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরখানের মাস্টারপাড়া সোসাইটি রোডের একটি বাসায় নেহাল সাদিক নামে এক বছর বয়সী শিশুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করেন তারই মা মুক্তি বেগম। শিশুটির মা মুক্তি বেগম এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে তাত্ক্ষণিকভাবে স্থানীয়রা অভিযোগ তোলেন। পরে মুক্তিকে আটক করে পুলিশ। গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলার ঘোলহাড়িয়া গ্রামে সখিমন নামে এক মায়ের বিরুদ্ধে ১৪ বছরের শিশু সন্তান হত্যার অভিযোগ ওঠে। পরে এ শিশুর পিতা আলমগীর বাদী হয়ে পবা থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, আলমগীর ও তার স্ত্রী সখিমনের মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। এ সময় আলমগীর তার স্ত্রী সখিমনকে ঝাড়ু দিয়ে মারধর করেন। ক্ষোভে সখিমন শিশু আরজিনাকে রেখেই একই উপজেলার তেবাড়িয়া গ্রামে বাপের বাড়িতে চলে যান। পরে খাবারের জন্য কাঁদতে থাকলে শিশুর দাদি ও চাচি শিশুকে নিয়ে তেবাড়িয়ার দিকে রওনা হন। পথিমধ্যে শিশুটি মারা যায়। এ থেকে পরিবারের লোকজনের সন্দেহ হয়, মা সখিমন বাবার বাড়িতে যাওয়ার আগে শিশুটির মুখে বিষ দিয়েছিলেন। তাই রাস্তায় যেতেই আরজিনা মারা যায়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক কলহের জের ধরে সিরাজগঞ্জের রতনকান্দি ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে এক মায়ের হাতে খুন হয়েছে মাত্র ১১ মাস বয়সী একমাত্র পুত্র তানভিন হাসান।  হত্যার পর মা রুবিনা খাতুন শিশুটির লাশ একটি সুটকেসে ভরে ঘরের ভিতর লুকিয়ে রাখেন। এ ঘটনায় রুবিনা খাতুনকে আটক করে পুলিশ। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রামপুরা বনশ্রীতে তার দুই সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মাহফুজা খাতুন। এ ঘটনায় শিশু দুটির বাবা আমানুল্লাহ রামপুরা থানায় স্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। ওই ঘটনায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়-ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নিয়ে মাহফুজা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। একপর্যায়ে ছেলেমেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন তিনি। তার নিহত দুই সন্তানের মধ্যে বড় নুসরাত আমান অরণী (১৪) ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী। আর ছোট আলভী আমান (৬) হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের শিক্ষার্থী। গত ১২ আগস্ট রাতে রাজধানীর উত্তর বাসাবোর ১৫৭/২ ষড়ঋতু নামের একটি ছয়তলা ভবনের চিলেকোঠায় দুই ভাই-বোনকে গলা কেটে হত্যা করে মা তানজিনা খাতুন। নিহত দুই শিশু হলো- হুমায়রা বিনতে মাহবুব তাকিয়া (৬) ও মাশরাফি ইবনে মাহবুব আবরার (৭)। ঘটনার পরদিন রাতে বাসাবোর সিদ্বেশ্বরী সার্কুলার রোডের ঘিলপাড় মসজিদের সামনে থেকে পুলিশ ওই নারীকে আটক করে। পরে পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। বর্তমানে তিনি পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব হত্যার রহস্য বিভিন্ন রকমের হতে পারে। এ জন্য জানতে হবে অভিযুক্তের সামাজিক, পারিবারিক, শৈশব-কৈশোর ও দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ বলেন, কয়েকটি কারণে বাবা-মা বা অভিভাবক তার সন্তানকে হত্যা করতে পারেন। নিজের কিছু অনৈতিক অপকর্ম ঢাকতে, হতাশা থেকে, নিজের কাজে বাধা হিসেবে মনে করলে বা অন্যের ওপর যে কোনো কারণে ক্ষোভে সন্তানকে হত্যা করতে পারে। আবার কোথাও স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ি দ্বারা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার গৃহবধূও এ রকম ঘটনা ঘটাতে পারে। তিনি এও বলেন, অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে মানসিক যন্ত্রণা বা মনোকষ্টে ভুগলে এসব হয়। এ জন্য প্রোপার কাউন্সিলিং দরকার। প্রত্যেককে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন বলেন, আমরা সাম্প্রতিককালে বাবা-মার হাতে সন্তান খুন হওয়ার চিত্র বেশি লক্ষ্য করছি। এটা মূলত সামগ্রিক সামাজিক অস্থিরতা, সন্তানকে নিয়ে অতিমাত্রার শঙ্কার প্রতিফলন। মানুষ দিন দিন অধৈর্য হয়ে উঠছে। এগুলো প্রাকৃতিক কিছু নয়, এগুলো মানুষ দ্বারাই সৃষ্ট। এ জন্য আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক সচেতনতা ও সম্প্রীতি বাড়াতে হবে।

সর্বশেষ খবর