বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ওদের খবর রাখে না কেউ

সাঈদুর রহমান রিমন

ওদের খবর রাখে না কেউ

‘বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সীমান্ত এলাকা থেকে শুরু করা সশস্ত্র প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীরা কেউ ভালো নেই। অধিকাংশ যোদ্ধাই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। বেশির ভাগ প্রতিরোধযোদ্ধা বাড়িঘর হারিয়ে রাস্তার ফকির হয়ে গেছেন। দুইবেলা ভাতও জুটছে না তাদের। গত সাত বছরে বিনা চিকিৎসায় অন্তত ৩৯ জন প্রতিরোধযোদ্ধার করুণ মৃত্যু ঘটেছে। কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি, পাশে দাঁড়ায়নি।’ তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বললেন গুরুতর অসুস্থ প্রতিরোধযোদ্ধা স্বপন চন্দ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পঁচাত্তরে যাদের বার বার ডেকেও প্রতিবাদযুদ্ধে ঘেঁষানো যায়নি, তারাই আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বুলি আউড়িয়ে মুখে ফেনা তুলছেন। সরকারের, দলের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা লুফে নিচ্ছেন তারা। অথচ বঙ্গবন্ধুর জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়া প্রতিরোধযোদ্ধা ও তাদের পরিবার-পরিজন থাকছেন অর্ধাহারে-অনাহারে। মারা যাচ্ছেন বিনা

চিকিৎসায়’—এটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বপন চন্দ।

পঁচাত্তরের প্রতিরোধ ময়দানে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী স্বপন চন্দ দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ও আলসারের জটিল রোগে ভুগছেন। এক হাতে কোমর ধরে অন্য হাতটি পেটব্যথার স্থানে চাপা দিয়ে তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের সাহায্যের আর্তি নিয়ে রাজধানীময় ঘুরে বেড়ান। স্বপন চন্দ বলেন, ‘কারও কাছ থেকে বিশেষ কিছু পাওয়ার আশায় আমরা প্রতিরোধযুদ্ধ করিনি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের আদর্শের পিতা। তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সন্তান হিসেবে যে দায়িত্ব ছিল সেটুকুই শুধু পালনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেই দুর্বিষহ সময়ে যাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাসের পর মাস প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়েছি, আজ তাদের ধুঁকে ধুঁকে মারা যাওয়ার বিষয়টি কোনোভাবে মেনে নিতে পারি না বলেই দ্বারে দ্বারে সাহায্য প্রার্থনা করি।’ স্বপন চন্দের মতো নিজের জটিল কঠিন ব্যাধির চিকিৎসায় সহায়তার আর্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলেন সাধন সরকার নামের অপর এক প্রতিরোধযোদ্ধা। নেত্রকোনার দুর্গাপুর থানা সদরে তার বাড়ি। নানা আবেদন-নিবেদনের বিপরীতে আশ্বাস জুটলেও কারও কাছ থেকে সহযোগিতা মেলেনি তার ভাগ্যে। বিনা চিকিৎসা আর অর্ধাহারে-অনাহারে সাধন সরকার এরই মধ্যে মারা গেছেন। তার নাবালিকা দুটি মেয়ে আশ্রয়হীন অবস্থায় অপরের দয়ায় কোনোমতে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। মা-বাবা হারা মেয়ে দুটি যেন অকূল পাথারে ভাসছে। স্কুলের ছুটিছাটায় হোস্টেল ছেড়ে সবাই যখন নিজ নিজ বাড়ির পথে পা বাড়ায়, তখন সাধনের দুই মেয়ে পড়ে সীমাহীন বিপাকে। কোথাও দাঁড়ানোর জায়গাও যে নেই তাদের।

সাধনের মতো সাহায্যের আশায় এখনো পথ চেয়ে থাকেন তীব্র অভাবগ্রস্ত শতাধিক প্রতিরোধযোদ্ধা। এদের মধ্যে প্রায় ৩০ জনই ভুগছেন নানা জটিল রোগে। চিকিৎসা, পথ্য দূরের কথা, নিজেদের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানার জন্য কোনো চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মতো সাধ্যও নেই তাদের। নেত্রকোনা শহরের প্রতিরোধযোদ্ধা সাইয়েদুল কাদির ক্যান্সারে আক্রান্ত, তিনি কয়েক মাস ধরে ঘরে পড়ে আছেন। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের ইসমাইল কমান্ডার, নেত্রকোনা শহরের নূর ইসলাম ও একই জেলার বালীর খুর্শেদ আলী, বাহিরচাপড়ার নূরুজ্জামান খান, সুধারঞ্জন সরকার, ফিরোজ খান, মোস্তাফিজুর রহমানদের জীবন চলছে অভাব যন্ত্রণায় সীমাহীন কষ্টে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে গারো পাহাড়ের সীমান্তে এসব মানুষই অদম্য সাহসে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের খবর এখন কেউ রাখে না। বেকারত্ব, অভাব আর কঠিন অসুখ-বিসুখে প্রতিরোধযোদ্ধাদের পরিবারগুলোয় চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পরপরই অস্ত্র হাতে গর্জে ওঠা দামাল ছেলেদের জীবন চলছে সীমাহীন কষ্ট-যন্ত্রণায়, অর্ধাহারে আর অনাহারে। আছে পদে পদে অবহেলা-বঞ্চনা। নিবেদিতপ্রাণ এই ‘মুজিবভক্তদের’ দীর্ঘশ্বাসই এখন একমাত্র সম্বল। গত সাত বছরে অভাব-যন্ত্রণায় ভুগে, বিনা চিকিৎসায় ৩৯ জন প্রতিরোধযোদ্ধার প্রাণ গেছে। আর মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আরও অর্ধশতাধিক বীরযোদ্ধা। কোনো রকম চিকিৎসা-সুবিধা ভাগ্যে জুটছে না তাদের। অনেক প্রতিরোধযোদ্ধা বাড়িঘর হারিয়ে আশ্রয়হীন অবস্থায় মানবেতর-জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছেন। দুইবেলা খাবার জোটানোই যাদের জন্য কষ্টকর, তাদের ওষুধ-পথ্য জুটবে কোত্থেকে! প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়া কমান্ডার, যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতির পিতাকে হারানোর শোকে মুহ্যমান একেকজন বীরযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন গেরিলাযুদ্ধে। টানা ২২ মাস যুদ্ধ শেষে তারা কেউ আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। পড়াশোনা চালাতে পারেননি। ফিরে পাননি ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রতিরোধযোদ্ধাদের জন্য স্থাপিত হাসপাতালের নার্স-কাম-চিকিৎসকের দায়িত্বে ছিলেন বারোমারী গ্রামের সূচনা ম্রং। তিনি এখন অন্যের জমিতে পাইট (কামলা) খেটে কষ্টে সৃষ্টে দুই মুঠো খাবার জোটান। নিজের আশ্রয়ভিটা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ায় স্বামী-সন্তান নিয়ে সূচনার ঠাঁই হয়েছে অন্যের জমিতে। অমানবিক-জীবনযাপনের কথা বলতে গিয়ে সূচনা বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রতিরোধযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে বার বার ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া গেরিলা কমান্ডার জিতেন্দ্র ভৌমিক বলেন, ‘পিতার (বঙ্গবন্ধু) রক্তের বদলা নিতে ছেলেদের যা করণীয় তা-ই করেছি, যে কারণে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিতেও ঘৃণা বোধ করেছি।’ অসমাপ্ত প্রতিরোধযুদ্ধের পর থেকেই টানা ৩৭টি বছর আসামের বিভিন্ন স্থানে নির্বাসনে ছিলেন তিনি। তার অনুপস্থিতিতে বাবা গজেন্দ্র ভৌমিক প্রশাসনিক নির্যাতনে মারা যান রোগেশোকে। মা চিত্রা ভৌমিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত, এখনো বেঁচে আছেন। জিতেন্দ্র ভৌমিক চোখের কোণে জমে ওঠা পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমি সেই সব সন্তানতুল্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছি, মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছি তাদের। বলছি, কাল যাব ঢাকায়, পরশু যাব ঢাকায়। সব জানাব জায়গা মতো। একটা কিছু করবই। একটা কিছু হবেই হবে।’ কিন্তু সেই একটা কিছু আর করা হয়ে ওঠে না জিতেন্দ্র ভৌমিকের। তাই তো নিজেই অনেকটা গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকেন বিরিশিরি এলাকায়। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মুখোমুখি হলে খুবই ব্যস্ততার ভান ধরে তিনি দিগ্বিদিগ ছুটে চলেন। জিতেন ভৌমিক ক্ষোভে দুঃখে বলে ওঠেন, আর পারছি না। ভাবছি আবার ভারতে পালিয়ে যাব।’ মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিরোধসংগ্রামী আজাদ খালেকের ছেলে তারেক আজাদ জানান, বীরযোদ্ধারা কোনো রকম সাহায্য-সহযোগিতা তো পাচ্ছেনই না, উপরন্তু তারা কেউ মারা গেলে লাশ দাফন করা হচ্ছে বেওয়ারিশ হিসেবে। কলমাকান্দার প্রতিরোধযোদ্ধা রশিদ চিশতি মারা যাওয়ার পর তার লাশ দাফন করতেও বাধা দেয় জামায়াতি চক্র। গোপালবাড়ীর প্রতিরোধযোদ্ধা শহীন্দ্র হাজং মারা যাওয়ার পর থেকে তার স্ত্রী অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে পেটের আহার জোটাচ্ছেন। যারা বেঁচে আছেন তাদের দুর্দশা বর্ণনা করার জো নেই। মহেশখোলার ডা. মোস্তফা, আতানগরের দ্বিজেন সরকার, লেঙ্গুরার বিপিন গুণ, পেটেক মারাক, ভাটিপাড়ার কালিদাস, বারহাট্টার রায়মোহন সরকার, সুলতান নুরী, আবদুর রহমান, নাজিরপুরের মো. ফরিদ, দুর্গাপুরের আলেক চানসহ বীরযোদ্ধাদের অনেকেই করুণ মিনতি জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের জন্য কিছু একটা করুন। আর তো বাঁচি না।’

সর্বশেষ খবর