শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

সিঙ্গাপুরের বুকে একখণ্ড বাংলাদেশ

প্রবাসের পথে পথে ১

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে

সিঙ্গাপুরের বুকে একখণ্ড বাংলাদেশ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বপ্নের দেশ সিঙ্গাপুর। আয়তনে বাংলাদেশের একটি জেলা বা তার চেয়ে একটু বড় হলেও অর্থনৈতিক বাজারে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সিঙ্গাপুর। আর এ দেশে কাজের সন্ধানে বাংলাদেশের হাজার হাজার বেকার যুবক পাড়ি জমায় প্রতিনিয়ত। সিঙ্গাপুরে যাওয়া মানেই বেকারত্ব দূর। সিঙ্গাপুরে কাজের নেই কোনো অভাব। শুধু কাজ আর কাজ। বাংলাদেশি শ্রমিকদেরও রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। শুধু চাহিদা নয়, বাংলাদেশিদের সুনামও রয়েছে বেশ ভালো। আর সিঙ্গাপুর মানেই অর্থ উপার্জনের একটি দেশ। এই সিঙ্গাপুরে রয়েছে বাংলাদেশিদের একটি আলাদা পরিচিতি। সিঙ্গাপুর নাগরিকদের চিন্তায় বাংলাদেশিরা খুব ভালো শ্রমিক। তারা (বাংলাদেশি) কাজে কোনো ধরনের ফাঁকি দেয় না। সময়ের কাজ সময়েই শেষ করার সুনামও রয়েছে বাংলাদেশিদের। সিঙ্গাপুর প্রবাসীরা কাজে ব্যস্ত থাকেন পুরো সপ্তাহ। কিন্তু একটু সময় পেলেই ছুটে আসেন দেশটির প্রাণকেন্দ্র মোস্তফা সেন্টার ও আশপাশ এলাকায়। স্থানটি বাংলাদেশি প্রবাসীদের কাছে মোস্তফা প্লাজা নামে পরিচিত।     

আর মোস্তফা সেন্টারের আশপাশের রোবাটস লেন, সৈয়দ আলওয়ী রোড, রয়েল রোড, কেজি কাপুর রোড, সিরাংগংসহ কয়েকটি এলাকায় বাংলাদেশি প্রবাসীদের সবচেয়ে বেশি আনাগোনা থাকে। বিকাল হলেই শুরু হয় উপস্থিতি। সন্ধ্যা হওয়া মাত্রই বাংলাদেশিদের উপস্থিতি বেড়ে যায়। দেখা হয় প্রবাসী একে অপরের সঙ্গে। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার দিন উপস্থিতি এমন হয় যেন বাংলাদেশের কোনো ব্যস্ততম এলাকা বা কোনো বার্ষিক মেলা। আর এতে অনেকটা বাংলাদেশিদের মিলনমেলায় রূপ নেয় মোস্তফা সেন্টার ও আশপাশ এলাকায়। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই শুধু বাংলাদেশি আর বাংলাদেশি। শুধু তাই নয়, আশপাশ এলাকায় বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্যের দোকান, খাবারের হোটেলসহ নানা ধরনের দোকান রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশি মোবাইল কোম্পানির টাকা লোড, বিকাশসহ সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় এই এলাকায়। এ যেন সিঙ্গাপুরের বুকে এক খণ্ড বাংলাদেশ। এখানে সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এখানকার দোকানিদের মধ্যে বেশিরভাগই বাংলাদেশি। কিছু চাইতেই বুঝে যান বাংলাদেশি। আর শুরু হয় বাংলায় কথা বলা। সিঙ্গাপুরের জিট হেং ইঞ্জি. প্রা. লি.-এর কর্ণধার মি. কিবি বলেন, বাংলাদেশিরা কাজে খুবই দক্ষ। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন এই দেশে। তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। তারা ঝগড়া ফেসাদও করে না। কিন্তু অন্যদেশিরা ঝগড়া করে বেশি। কাজে ফাঁকিও দেয় বেশি। সরেজমিন দেখা যায়, দেশটির প্রাণকেন্দ্র মোস্তফা সেন্টার ও আশপাশ এলাকায় বাংলাদেশি প্রবাসীদের আসা-যাওয়া। বৃহস্পতিবার বিকালে মোস্তফা সেন্টারের দক্ষিণে খোলা মাঠে হাঁটার সময় দেখা হয় গাজীপুরের ছোবাহান নামের এক প্রবাসীর সঙ্গে। দেখেই চিনে ফেলেন। খোঁজখবর নেন দেশের। আর আমাকে পেয়ে যেন ছোবাহান পুরো বাংলাদেশকে হাতে পেয়েছে। শুধু ছোবাহান নয়, একে একে করে জমতে থাকে ২০-২৫ বাংলাদেশি। সবাইকে দেখে মনে হলো এ যেন আরেকটি বাংলাদেশ। এ সময় কথা হয় শেখ শুভ নামের এক প্রবাসীর সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানে এলে দেশ ও এলাকার মানুষদের পেয়ে যাই। আর এতে মনটাও ভালো হয়ে যায়। কথা হয়, মোস্তফা সেন্টারের দক্ষিণে একটি ফ্ল্যাক্সিলোড ও বিকাশের দোকানি ইমরানের সঙ্গে। তার বাড়ি টাঙ্গাইল শহরের আকুরটুকুর পাড়ায়। তিনি বলেন, এখানে বিকাল হলেই অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। আমাদের কাছে সিঙ্গাপুর কোনো পরদেশ মনে হয় না। মনে হয় যেন দেশেই আছি, টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এসে কাজ করলে যেমনটা মনে হয়। ঠিক তেমনি মনে হয়। গাজীপুরের কাপাসিয়ার মাহবুব নামের এক প্রবাসী বলেন, বিকাল হলেই মোস্তফা সেন্টারের এক নম্বর গেট ও আশপাশে শুধু গাজীপুর ও কাপাসিয়ার লোকদের আনাগোনা থাকে। এখানে এক মিনিট দাঁড়ালেই দেখা হয় কয়েকশ বাংলাদেশির সঙ্গে। মোস্তফা সেন্টারের দক্ষিণেই রয়েছে আঙ্গুলিয়া নামের একটি মসজিদ। এই মসজিদে বাংলাদেশি প্রবাসীরা নামাজ আদায় করেন। মসজিদের দক্ষিণে রয়েছে বাংলাদেশি প্রবাসীদের সুবিধার্থে নানা পণ্যের দোকান। শবনম ট্রেডিং নামের একটি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানের সবাই বাংলাদেশি। এখানে অন্তত ১৫ জন বাংলাদেশি সেলসম্যান রয়েছেন। শুধু পুরুষই নয়, বাংলাদেশি নারী সেলসম্যানও রয়েছে। কথা হয় শবনম ট্রেডিংয়ের সেলসম্যান চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ইসমাইলের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানে বাংলাদেশি প্রবাসীরাই বেশি কেনাকাটা করেন। আর তাদের সুবিধার্থে সবাই বাংলাদেশি সেলসম্যান। ইসমাইল এই দোকানে কাজ করছেন ছয় বছর ধরে। পাশেই রয়েছে দেশের খ্যাতিমান ব্র্যান্ড আড়ং-এর একটি বিশাল শোরুম। রয়েছে ঢাকার ঘরোয়া হোটেলের নামে একটি হোটেল। হোটেল আল মোস্তফা, হিরাঝিল হোটেল, ম্যাক্রো ম্যাক্সসহ নানা নামের নানা দোকান। বরিশালের গৌরনদী এলাকার নাজির হোসেন বলেন, ২০০৯ সাল থেকে আছি। প্রবাসী জীবন কাটছে বেশ ভালোই। তবে মাঝে মধ্যে বাড়ির কথা মনে পড়লে কষ্ট হয়। কিন্তু বিকালে বা রবিবার দিন ছুটি পেলে মোস্তফা প্লাজায় এলেই যেন মনটা ভালো হয়ে যায়। দেখা হয় এলাকার অনেকের সঙ্গে। আর এতে মনে হয় না বিদেশের মাটিতে আছি। শুধু মোস্তফা সেন্টার এলাকা নয়, বাংলাদেশি প্রবাসীদের দেখা মেলে সেই ম্যারিনা বে, ক্লাকি, সন্তোসা, লিটল ইন্ডিয়া, সেরেংগং, বুগ্গিস, পেয়ালিবির, কালাং, কালাং বারো, নিউটন, ওরচাদ, সুমিরসেট, হারবারফন্ট, ম্যারিনা, উডল্যান্ড, ফিরার পার্কসহ বিভিন্ন এলাকায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের আরিফ নামের প্রবাসী জানান, পুরো সপ্তাহ কাজ করে ক্লান্ত হয়ে যাই। কিন্তু ছুটিরদিন রবিবার এলেই কখন মোস্তফায় যাব ব্যাকুল হয়ে উঠি। আর মোস্তফায় গিয়ে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। এতে মনটা ভালো হয়ে যায়। মনেই হয় না বিদেশের মাটিতে আছি। শুধু আরিফই নয়, শেখ শাকিল, আবুল কাশেম, মো. জাকির হোসেন, সাখাওয়াত মাঝি, মাহবুব, ইসমাইল, ইমরান, জামান, সাইফুল, শেখ শুভ, মহসিন, সাইফুল ইসলাম, রানা, সেলিম, সফিকুল, মিনহাজ, মাজেদ, বাবুলসহ অনেকেই এমনটা বলেন। শেখ শুভ জানান, সিঙ্গাপুর দেশটা অত্যন্ত ছোট হওয়ায় খুব সহজেই এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে যাওয়া যায়। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর স্বপ্নের মতো সাজানো একটি দেশ। এমআরটি (মেট্রো রেল) দিয়ে অল্প সময়েই গন্তব্যে পৌঁছা যায়।

সর্বশেষ খবর