দেশে বছরে ৩৫ লাখ টন মাছ উৎপাদন হয়, যার ৫৫ ভাগই পুকুরে চাষ করা। এসব মাছের একটি বড় অংশ হলো পাঙ্গাস, মাগুর, সিং ও পাবদা। ক্যাটফিশ-জাতীয় এ মাছগুলো। এসব মাছের রেণুর খাবার হিসেবে ড্রেন-পচা নর্দমা থেকে সংগ্রহ করা হয় টিউবিফিসিড নামের এক ধরনের পোকা। কিন্তু ড্রেন-নর্দমা থেকে সংগ্রহ করা এই পোকার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বর্ষা মৌসুমে আবার ড্রেনে এই পোকা পাওয়া যায় না। ফলে রেণু উৎপাদনকারীদের বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। তা ছাড়া ড্রেনে মানুষের মলমূত্রসহ নানা ধরনের বর্জ্য থাকে। যেখানে স্যালমোনেলা নামের মারাত্মক ক্ষতিকর একটি ব্যাকটেরিয়াও থাকে। এই ব্যাকটেরিয়া টিউবিফিসিডের সঙ্গে মাছের রেণুকে খাওয়ালে রেণুর যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি মানবদেহের জন্যও বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে। তাই মত্স্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বড় ধরনের সাফল্য দেখালেও নিরাপদ মত্স্য উৎপাদনের বিষয়টি বেশ কিছুটা ঝুঁকির মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। এ চিন্তা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্য বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ হাসান ক্যাটফিশ-জাতীয় মাছের রেণুর নিরাপদ খাবার হিসেবে টিউবিফিসিড পোকার বাণিজ্যিক উৎপাদনের বিষয়ে গবেষণার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প জমা দেন। ২০১৪ সালে এ প্রকল্প পাস হয় এবং ২০১৬ সালে এ প্রকল্পের জন্য ২৭ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্য বিজ্ঞান বিভাগ ও যশোরের মা ফাতেমা ফিশ হ্যাচারি যৌথভাবে টিউবিফিসিড পোকা বাণিজ্যিক উৎপাদনের গবেষণা কাজ শুরু করে। গতকাল রবিবার তাদের এ গবেষণা সফলতার মুখ দেখে। প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদ হাসান বলেন, গবেষণার অংশ হিসেবে যশোর শহরের মা ফাতেমা ফিশ হ্যাচারিতে মাত্র ১০ ফুট বাই ২০ ফুট আকারের একটি কালচার সিস্টেম তৈরি করা হয়। এখানে মাত্র ৩০ দিনে ৫০ কেজি টিউবিফিসিড পোকা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। ৫০০ টাকা কেজি হিসেবে যার মূল্য ২৫ হাজার টাকা। ড. মাহমুদ হাসান বলেন, এভাবে উৎপাদন করা টিউবিফিসিড মাছের জন্য যেমন নিরাপদ, মানবদেহের জন্য সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত। যেসব মত্স্যচাষি পাঙ্গাস, মাগুর, সিং, পাবদা মাছের চাষ করেন, তাদের কাছে এই টিউবিফিসিড পোকার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই বাণিজ্যিকভাবে যে কেউ এই টিউবিফিসিড পোকা উৎপাদন করে লাভবান হতে পারেন। তিনি বলেন, ১০ ফুট বাই ২০ ফুটের একটি কালচার সিস্টেম তৈরি করতে দুই লাখ টাকারও কম খরচ হয়। এই খরচটা কেবল প্রথমবারই হবে। একবার এটি তৈরি করলে তা থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত একটানা টিউবিফিসিড উৎপাদন করা যাবে। আর এর উৎপাদন প্রক্রিয়াতে খরচও খুব কম। তিনি বলেন, ৪০ ভাগ সরিষার খৈল, ৩০ ভাগ সয়াবিন মিল আর বাকি ৩০ ভাগ কাদামাটির সঙ্গে রক্ত, ভাতের মাড় ও পানি দিয়ে সাত দিন ভিজিয়ে রাখতে হয়। এই ফিড (২ কেজি ২০০ গ্রাম) আর ৩০০ মিলিগ্রাম বীজ পোকা দিয়ে এক মাসে ৪ কেজি পর্যন্ত টিউবিফিসিড উৎপাদন করা যাচ্ছে। মা ফাতেমা ফিশ হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী ফিরোজ খান বলেন, ফুড সিকিউরিটির বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা এভাবে টিউবিফিসিড উৎপাদনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। এভাবে উৎপাদিত টিউবিফিসিড পোকা রেণু পোনার জন্য যেমন নিরাপদ, তেমনি মানবদেহের জন্যও আশঙ্কামুক্ত। আর যারা ড্রেনে মলমূত্র, পচা কাদামটি ঘেঁটে পোকা সংগ্রহ করে, তারাও নানা রোগে আক্রান্ত হয়। পরিকল্পিতভাবে টিউবিফিসিড তৈরি করলে এসব লোকজনও রোগ-শোকের হাত থেকে মুক্ত থাকবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি হবে। যশোরের চাঁচড়া এলাকার মত্স্যচাষি জাহিদুর রহমান জাহিদ বলেন, ক্যাটফিশ-জাতীয় মাছের খাদ্য হিসেবে এখন শুঁটকি মাছ ব্যবহার করা হয়। এভাবে উৎপাদিত টিউবিফিসিড সহজলভ্য হলে অবশ্যই রেণু পোনার চাষিরা এটি ব্যবহার করবে।
প্রকল্প পরিচালক ড. মাহমুদ হাসান বলেন, অনেক মত্স্যচাষি ৫০/৬০ লাখ টাকা খরচ করে হ্যাচারি তৈরি করেন। তারা খুব সহজেই দেড়-দুই লাখ টাকা খরচ করে অল্প জায়গায় এ ধরনের একটি কালচার সিস্টেম তৈরি করতে পারেন। এতে নিজেদের চাহিদা পূরণ করেও তারা মাছের এ খাবার বাইরেও বিক্রি করতে পারবেন। ড. মাহমুদ হাসান বলেন, এখন মাছের খাবার উৎপাদনের এই প্রক্রিয়া মত্স্য অধিদফতর ও এনজিওদের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।