শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
সাহায্য প্রার্থনায় জালিয়াতি

অভিনব কায়দায় হাতানো হচ্ছে টাকা

মাহবুব মমতাজী

ইউসুফ খান, তার সঙ্গে যুক্ত ছেলে শাহজাদা ইমরান খান। তারা অভিনব কায়দায় মানুষ ঠকিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। কোথাও বাবা, কোথাও চাচা, আবার কোথাও ভাই ও মামা পরিচয় দিয়ে আবেদন করছেন সাহায্যের। তাদের সাহায্যের উপলক্ষ থাকছে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির। এর প্রমাণ তুলে ধরতে উপস্থাপন করা হচ্ছে জাল-জালিয়াতি করা কাগজপত্র।

এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাপ-ছেলের সঙ্গে কাজ করছে একটি বড় সংঘবদ্ধ চক্র। যেটির স্থান নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়ে। সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাদকের আড্ডাখানাও। শুধু সাহায্যের আবেদনেই তাদের জালিয়াতি সীমাবদ্ধ নেই। এই চক্র রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, চুরি, প্রতারণা ও অপহরণের সঙ্গেও জড়িত। এ পর্যন্ত সাহায্যের আবেদন করে অন্তত সাতটি জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়েছে এ চক্র। তবে এখন পর্যন্ত এরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

একটি ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে, গত ২০ জুন ইউসুফ আলমের কিডনি অপারেশনের কথা বলে বিভিন্ন স্থানে সাহায্যের আবেদন করেন ইউসুফ খান। সঙ্গে যুক্ত করা হয় চিকিৎসকের পরামর্শপত্র। আবেদনে তিনি নিজেকে ইউসুফ আলমের বাবা পরিচয় দেন। তবে সেখানে নিজের নাম দেখান ইউসুফ হারুন বলে। আবেদনে বলা হয়, ‘আলমের একটি কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট, অপরটি দুর্বল। জরুরি ভিত্তিতে অপারেশনের মাধ্যমে কিডনি বদলাতে হবে। যার জন্য চার লাখ টাকা প্রয়োজন। এ পর্যন্ত অভাবের সংসারে তিনি ৪৪ হাজার টাকা ধার করেছেন।’ এতে আরও বলা হয়, ‘অসুস্থ এগারো বছরের ইউসুফ আলম সিদ্ধিরগঞ্জ ক্যাডেট হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বর্তমানে সে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের কিডনি বিভাগের প্রধান ডা. নাসির আহমেদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন।’ অনুসন্ধান পর্বে বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য যোগাযোগ করা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিসের প্রধান ও কর কর্মকর্তা মোহাম্মদ হান্নান মিয়া মানিক জানান, তার জানামতে ওই এলাকায় সিদ্ধিরগঞ্জ ক্যাডেট হাইস্কুল নামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। একই কথা জানান স্থানীয়রাও।

এরপর ডা. নাসির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আবেদনে যে প্রেসক্রিপশন আর ওষুধের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা তারই এবং তার হাতে লেখা। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইউসুফ আলমকে তিনি এই প্রেসক্রিপশন দেননি। দিয়েছেন ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক এক ব্যক্তিকে। আবেদনে সংযুক্ত প্রেসক্রিপশনটিতে ওই ব্যক্তির নাম, বয়স ও দিন পরিবর্তন করে ইউসুফ আলমের নাম যুক্ত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রেসক্রিপশনটিতে সিএবিজে নামে একটি অপারেশনের এবং একটি ওপেন হার্ট সার্জারির কথা উল্লেখ করেছি। যেটি করা হয়েছিল ২০১১ সালে। আর ওইসব অপারেশন কখনো ১১ বছরের শিশুকে করা সম্ভব হয় না। এখানে বড় ধরনের জালিয়াতি করা হয়েছে।’

আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়, গত ১০ আগস্ট ১৮ বছরের তরুণী ফরিদা খানমের ব্রেইন টিউমারের অপারেশনের খরচের টাকা জোগাড় করতে সাহায্যের আবেদন করা হয়। সেখানে ওই তরুণীকে ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। আর আবেদনটি করেছেন শাহজাদা ইমরান খান। সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে কলেজে ভর্তির রসিদ যুক্ত করেছেন এবং আবেদনে ফরিদার মামা পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ওই আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘মাথায় অত্যধিক চিন্তা ও চাপের কারণে ফরিদা শরীরের প্রতি খেয়াল রাখতে পারেনি। ফলে তার অবস্থার অবনতি হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ডাক্তার দেখানো হয়। সেখানে তারা জানান, ফরিদার ব্রেইন টিউমার। দ্রুত তার মাথায় মেজর অপারেশন করাতে হবে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ড. ফরিদা খান বলেন, ‘সাহায্যের আবেদনে যাকে আমাদের ছাত্রী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে, সে নামে কেউই এখানে নেই। আর বিভাগের যে ভর্তি রসিদ যুক্ত করা হয়েছে তাতেও জালিয়াতি করা হয়েছে। কারণ আমাদের বিভাগের রোল নম্বর শুরু হয়েছে ছয় হাজার দিয়ে। সেখানে যে রোলটি (১০১৬২) দেওয়া হয়েছে তা শুরু হয়েছে দশ হাজার দিয়ে। এতেই সম্পূর্ণ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে।’

একই কলেজের সব কিছু অপরিবর্তিত রেখে বিলকিস আক্তারের নামে আরেকটি সাহায্যের আবেদন করা হয়েছে। বিলকিসকে ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগের এম এ পরীক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। আবেদনে বলা হয়, ‘জরুরিভাবে তার ওপেন হার্ট অপারেশন করাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন দুই লাখ ১০ হাজার টাকা। একই কারণে ধারদেনা করা হয়েছে ১৯ হাজার টাকা।’   

গত ৩১ আগস্ট সুমাইয়া নামের এক ছাত্রীর নাম ভাঙিয়ে আরেকটি সাহায্যের আবেদন করেন শাহজাদা ইমরান খান। আবেদনে বলা হয়, ‘সুমাইয়া চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী।’ ইমরান তার পরিচয় দিয়েছেন সুমাইয়ার মামা। তিনি নারায়ণগঞ্জ আদমজী ইপিজেড প্রকল্পের নিশাত গার্মেন্টের লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু আদমজী ইপিজেডের মোট ২২৯টি শিল্প-প্লটের তালিকায় নিশাত গার্মেন্ট নামে কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই। এ সম্পর্কে ইপিজেডের কাউন্সিলর (ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন) মো. মোজাম্মেল হোসাইন খান বলেন, ‘এ নামের কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের এখানে নেই। আর এ প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিয়ে সাহায্যের আবেদন করা মানে বড় ধরনের এক জালিয়াতি-প্রতারণা।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, একই চক্রের একই ব্যক্তিরা এমনিভাবে বিভিন্নজনের সঙ্গে নানা কৌশলে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। এর জন্য তারা নিচ্ছেন বড় ধরনের জালিয়াতির আশ্রয়। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, ইউসুফ খান এবং শাহজাদা ইমরান খানের নেতৃত্বে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়ে আছে বড় একটি অপকর্মের সিন্ডিকেট। যেখান থেকে রাজধানী ও তার আশপাশে চুরি, ছিনতাই, প্রতারণা, অপহরণ ও জালিয়াতি পরিচালনা করা হয়। এমনকি সানারপাড়ের বাসিন্দারা তাদের বিরুদ্ধে ডাকাতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেছেন। জানা গেছে, ইউসুফ খান ও ইমরানের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার এলখোলায়।

এ বিষয়ে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিতভাবে যে কোনো সংঘবদ্ধ চক্রকে নিয়ে কাজ করি। এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতারণা, অপহরণ ও জঙ্গিবাদে যুক্ত চক্রের বিরুদ্ধে আমরা অ্যাকশনে গেছি। আমাদের কাজ চলছে, আর এ চক্রটি নিয়েও আমরা কাজ করব।’

সর্বশেষ খবর