মঙ্গলবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অরক্ষিত সীমান্ত অস্ত্র ঢুকছে দেদার

সাখাওয়াত কাওসার

অরক্ষিত সীমান্ত অস্ত্র ঢুকছে দেদার

অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দেশের সীমান্ত। অবৈধ-অস্ত্র বিস্ফোরকে সয়লাব হয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবেই, সীমান্তের ১১৯টি পয়েন্ট দিয়েই অস্ত্র ঢুকছে। চকচকে অবৈধ অস্ত্র এখন সন্ত্রাসীদের হাতে হাতে। খাল বিল থেকেও উদ্ধার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে অনেকটাই সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৮ বছরে অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা জানান, চাইলেই অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সীমান্তের সব যানবাহন তল্লাশি করা সম্ভব হয় না।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সীমান্তে চোরাচালান ঠেকাতে বিজিবির সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সীমান্তে কড়া টহল থাকার কারণেই অস্ত্র খুব একটা ঢুকছে না। তবে স্থলবন্দর দিয়ে আসা প্রতিটি গাড়ি তল্লাশি করা সম্ভব হয় না। এতে ব্যবসায়ীরা হয়রানির অভিযোগ করেন। তিনি আরও বলেন, সীমান্ত বরাবর ৯০০ কিলোমিটার রাস্তার বিষয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ২৮৪ কিলোমিটার রাস্তার ব্যাপারে অনুমোদন মিলেছে। টেকনাফ থেকে সীমান্ত বরাবর এসব রাস্তার কাজ চলছে। পুরো সীমান্ত বরাবর রাস্তা নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেলে সীমান্তে আরো টহল নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি। জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইসহ ফুটপাত দখলে ও ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। সম্প্রতি রাজধানীর গুলিস্তানে ফুটপাত দখলকে কেন্দ্র করে আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে এবং গত সপ্তাহেই নোয়াখালীতে বকাঝকা করায় এক ছাত্র কলেজ অধ্যক্ষকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যার হুমকির বিষয়টি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছে। পেশাদার সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারা সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ ক্ষুদ্রাস্ত্র নিয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা। চাহিদা মেটাতে দেশের অন্তত ১১৯টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে বিপুলসংখ্যক অবৈধ অস্ত্রের চালান। এগুলোর মধ্যে বেশি ঢুকছে বিলোনিয়া, আমতলী, মরারচর, বিনোদপুর, চল্লিশপাড়া, গোড়েরচর, হাকিমপুর, বাখর আলী ও বাগডাঙ্গার মতো ২৫টি পয়েন্ট দিয়ে। গত ১৮ জুন উত্তরার খাল থেকে ১০৮টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি উদ্ধার করা হয়। তবে পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও ওই অস্ত্রের উৎস কিংবা কারা কি উদ্দেশ্যে এনেছিল এ ব্যাপারে এখনো কোনো তথ্য দিতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বাংলাদেশের ইতিহাসে গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃশংস জঙ্গি হামলায় ব্যবহূত অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং গাজীপুর, মিরপুর এলাকার জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত একে-২২, বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র এবং বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক বড় ধরনের নাশকতার ইঙ্গিত দিয়েছিল। তবে কি পরিমাণ বড় ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র এখন জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসীদের কাছে আছে এ সম্পর্কে খুব একটা ধারণাও নেই গোয়েন্দাদের। গত ৩১ অক্টোবর ১০টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ ভারতীয় নাগরিক খাইরুল মণ্ডলকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। পুলিশ বলছে, ঢাকায় আসা এ অস্ত্র বিহারের তৈরি। বিহার  থেকে এসব অস্ত্র পলিথিনে মুড়িয়ে বালুর ট্রাকের ভেতরে রাখা হয়। এরপর এসব ট্রাক পশ্চিমবঙ্গে এলে সেখান থেকে অস্ত্র আনা হয় উত্তর চব্বিশ পরগনার আস্তানায়। সেখান  থেকে একটি স্কুলব্যাগে করে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ঢাকায় অস্ত্রগুলো নিয়ে আসা হয় বলে জানিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মহররম আলী বলেন, খাইরুল একজন বড় মাপের অস্ত্র ব্যবসায়ী। কয়েকজন সহযোগীসহ ঢাকায় এসেছিলেন একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে অস্ত্রগুলো বিক্রি করতে। যাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করার চুক্তি হয়েছিল, তাদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। ডিবি পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার আব্দুল বাতেন জানান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তত্পরতার কারণে মাঝে মাঝেই অবৈধ অস্ত্রধারী ও ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। তবে অস্ত্রগুলো সীমান্ত দিয়েই ঢুকছে বলে জানান তিনি। উত্তরা থেকে উদ্ধারকৃত ১০৮টি আগ্নেয়াস্ত্রের তদন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো মন্তব্য করার সময় আসেনি। তদন্ত অব্যাহত আছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, ঢাকাসহ সারা দেশে অবৈধ অস্ত্রের দুই শতাধিক ব্যবসায়ী আছে। শুধু রাজধানীতেই অন্তত ১৫টি গ্রুপ অস্ত্র কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যও রয়েছে। এ গ্রুপগুলো ডিলারদের কাছে অস্ত্রের চাহিদা দেয়। তাদের চাহিদা অনুযায়ী ডিলাররা অস্ত্র সরবরাহ করে। ভারতীয় তৈরি ক্ষুদ্রাস্ত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় কিনে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। সীমান্তে আরও কম দামে অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে জলদস্যুসহ সন্ত্রাসীদের কাছে ১৫  থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, চলতি বছর শুধু রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেড় শতাধিক ক্ষুদ্রাস্ত্র উদ্ধার করেছে। রাজধানীতে চলতি বছর চার শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ২০১৫ সালে সারা দেশে ১ হাজার ৩০১টি অস্ত্র উদ্ধার হয়। অন্যদিকে, বিজিবি ১০ মাসে ৫৬টি পিস্তল, ৩৭টি বিভিন্ন ধরনের বন্দুক, ৪ হাজার ৭ রাউন্ড গোলাবারুদ জব্দ করে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর