রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজনীতির হালচাল বরিশালে

শক্ত অবস্থানে আওয়ামী লীগ, অগোছালো বিএনপি এগোচ্ছে ইসলামী আন্দোলন

রাহাত খান, বরিশাল

রাজনীতির হালচাল বরিশালে

টানা আট বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বরিশালে। জেলায় সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস এমপির নেতৃত্বে বেশ সংগঠিত আওয়ামী লীগ। তবে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মাত্র তিন দিন আগে অনুমোদন হওয়া মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে রাজনীতি প্রায় শেষ হয়ে গেছে গত একযুগ নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা প্রয়াত সভাপতি, সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণপন্থিদের। অপরদিকে বিএনপির ‘ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত বরিশালে অগোছালো আট বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপি। উত্তর জেলা বিএনপি চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। সভাপতি-সম্পাদকের ঠাণ্ডা লড়াইতে স্থবির দক্ষিণ জেলা বিএনপির রাজনীতি। এক নেতার এক পদ নীতি কার্যকর হলে মহানগর বিএনপির সভাপতি পদ ছাড়তে হতে পারে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারকে। সাধারণ সম্পাদকও ভারপ্রাপ্ত। এদিকে বিএনপি-আওয়ামী লীগের বাইরে বরিশালে ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় পার্টি ছাড়া তেমন ভিত্তি নেই অন্য দলের। জামায়াতে ইসলামীর মোটামুটি একটা অবস্থান থাকলেও গত কয়েক বছরে সরকারি দমন-নিপীড়নের কারণে তারা নিশ্চিহ্ন প্রায়। ওয়ার্কার্স পার্টিরও কিছুটা ভিত্তি আছে বরিশালে। এ ছাড়া জাসদ, সিপিবি, বাসদ, ন্যাপ, সাম্যবাদী দল, বিজেপি, জেপি, এনপিপি, এলডিপি, বিকল্পধারা, কল্যাণ পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাউন্সিল ছাড়া বিভিন্ন দিবসের কর্মসূচির মধ্যে সিমাবদ্ধ। গণমাধ্যম অফিসে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েই বছর পাড় করছেন তারা। ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর কাউন্সিল অনুষ্ঠানের চার বছর পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি পায় জেলা আওয়ামী লীগ। হাসানাত-ইউনুসের নেতৃত্বে ভালোই চলছে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। জেলার সবগুলো উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড শক্তিশালী তাদের নেতৃত্বে। এমনকি জেলার ১০ উপজেলা, ছয়টি পৌরসভা এবং তিনটি ইউনিয়ন বাদে সবগুলোতে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন ও তাদের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন হাসানাত আবদুল্লাহ। শুধু জেলায়ই নয়, পুরো বিভাগে স্থানীয় সরকারের মনোনয়ন এবং তাদের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় বিশেষ মর্যদায় অধিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে হাসানাত আবদুল্লাহ। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস এমপি বলেন, হাসানাত আবদুল্লাহ নেতা-কর্মী বান্ধব। তিনি সবার সুখে-দুঃখে পাশে থাকেন। তিনি বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চল আওয়ামী লীগের অভিভাবক। তার নেতৃত্বে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চল আওয়ামী লীগ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত। অন্যদিকে নেতৃত্বের পালা বদল হয়েছে মহানগর আওয়ামী লীগে।

ভোটের রাজনীতিতে বরিশালে বরাবরই এগিয়ে বিএনপি। কিন্তু বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত বরিশালে বিএনপি এখন বড়ই অগোছালো। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এক বছরের ব্যবধানে দুই দফা আন্দোলনে ৪৮ মামলার আসামি হয়ে ছন্নছাড়া বিএনপির দুই হাজার নেতা-কর্মী। এসব মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে দিতে অর্থ এবং সময় দুটিই যাচ্ছে তাদের। হাতে গোনা কিছু নেতা ছাড়া মামলার জালে আর্থিকভাবে নিঃস্ব প্রায় তারা। এ ক্ষেত্রে দলের কাছ থেকে আইনি এবং আর্থিক কোনো ধরনের সহযোগিতাই পাননি তারা। দলের প্রতি বিমুখ অনেকে চাকরি কিংবা ব্যবসার চেষ্টা করছেন। মেজবাউদ্দিন ফরহাদকে সভাপতি এবং আ ক ন কুদ্দুসুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে বরিশাল জেলা (উত্তর) বিএনপির ১৫০ সদস্যের সব শেষ কমিটি গঠিত হয় ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বরে। তিন বছর মেয়াদি এই কমিটির বয়স প্রায় ছয় বছর। কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ স্বীকার করে উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি মেজবাউদ্দিন ফরহাদ বলেন, তিনি শিগগিরই ঢাকা গিয়ে উত্তর জেলা বিএনপির কাউন্সিল করার জন্য কেন্দ্রের অনুমতি চাইবেন। কাউন্সিল হলে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি সংগঠন এবং নেতা-কর্মীরাও উজ্জীবিত হবে বলে আশাবাদী সাবেক এমপি ফরহাদ।

২০১৩ সালে এবায়েদুল হক চানকে সভাপতি ও আবুল কালাম শাহিনকে সাধারণ সম্পাদক এবং পাঁচজনকে সহসভাপতি করে সাত সদস্যের বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। পরে ১৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে জমা দেওয়া হয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন হওয়ার আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে তিন বছর মেয়াদি বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি। দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়েদুল হক চান বলেন, দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি প্রবর্তন হয়েছে। এ কারণে ১৭১ সদস্যের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনেকে বাদ পড়বেন। নতুন নীতির কারণে প্রস্তাবিত কমিটি সংশোধন করে কেন্দ্রে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।

বরিশালে আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে চরমোনাই পীর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া তেমন জনসম্পৃক্ততা নেই অন্য দলের। বিভক্তির কারণে জাতীয় পার্টি নিঃশেষের দিকে। জামায়াতে ইসলামীর কিছুটা সাংগঠনিক শক্তি থাকলেও মাঠেই দাঁড়াতে পারছে না তারা। চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় বরিশালে মোটামুটি অবস্থান আছে ধর্মভিত্তিক এই দলটির। জেলা ও মহানগরে শক্তিশালী কমিটি রয়েছে ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের। তবে কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টেকার মতো ভোটব্যাংক নেই তাদের। এক সময়ের বাঘা বাঘা নেতারা দল ত্যাগ করায় বরিশালে দুর্বল হয়ে গেছে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি। এর মধ্যেও এখানে দলকে আগলে রেখেছিলেন শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ মহসিন-উল ইসলাম হাবুল এবং মীর জসিমউদ্দিন। কিন্তু এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বাদ দিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়ার পর একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েন দীর্ঘদিন নেতৃত্বে থাকা হাবুল-জসিমরা। ওই সময়ে দলের কাউন্সিলে মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি করা হয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মোর্তুজা আবেদীনকে। জেলায় নতুন কমিটি না হলেও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপুকে আহ্বায়ক করে গত বছর গঠন করা হয় জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি।

সম্মেলন হলেও আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে জেলা জাতীয় পার্টি পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি আজও। যদিও এ বি এম রুহুল আমীন ফের মহাসচিব হওয়ায় কর্তৃত্ব ফিরে পেয়েছেন হাবুল-জসিমরা। সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বরিশালের সন্তান হওয়ায় জেলার কয়েকটি উপজেলা এবং মহানগরে মোটামুটি অবস্থান আছে এই দলটির। নজরুল হক নীলুকে সভাপতি ও অ্যাডভোকেট শেখ টিপু সুলতান এমপিকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সবশেষ কমিটি হয় গত বছর ১৪ মার্চ। শান্তি দাসকে আহ্বায়ক এবং ছয়জনকে সদস্য করে মহানগরীতে প্রথমবারের মতো ওয়ার্কার্স পার্টির সাত সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয় গত ৩ জানুয়ারি। সরকারের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের অবস্থা বরিশালে একেবারেই শোচনীয়। শহীদুল ইসলাম মিরনকে সভাপতি, অ্যাডভোকেট আবদুল হাই মাহবুবকে সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বাদলকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে জেলা জাসদের সব শেষ কমিটি হয় ২০১১ সালে। গত ৬ মার্চ মজিবুল হককে সভাপতি এবং মো. মুকুলকে সাধারণ সম্পাদক করে মহানগর জাসদের ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি হলেও তাদের রাজনীতির মাঠে দেখা যায় না। দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে বিভক্তির ছাপ পড়েছে বরিশালেও। হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্ব ত্যাগ করে নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বে জাসদের আলাদা বলায় সৃষ্টি হলে বরিশালে বেশিরভাগ নেতা-কর্মী ঝুঁকে পড়ে তাদের (নুরুল আম্বিয়া-নাজমুল হক প্রধান) দিকে। জেলার সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাই মাহবুব ছাড়া নেতৃত্ব পর্যায়ের সবাই এখন ইনুর ঘোর বিরোধী। স্থানীয়ভাবে জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অনেক আন্দোলনে সব সময় পাশে থাকেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা অ্যাডভোকেট এ কে আজাদ। তাকে (আজাদ) সভাপতি ও অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে চার বছর মেয়াদি জেলা কমিটি গঠিত হয় প্রায় আড়াই বছর আগে। মোসলেম সিকদারকে সভাপতি এবং অধ্যক্ষ দুলাল চন্দ্র মজুমদারকে সাধারণ সম্পাদক করে সিপিবির মহানগর কমিটি গঠিত হয় ২০১৪ সালে। জেলা সমন্বয়ক ডা. মনীষা চক্রবর্তীর জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণে বরিশালে কিছুটা পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। এ বি এম মাসুদকে সভাপতি এবং মেহেদী হাসান রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫১ সদস্যের মহানগর এনপিপি’র কমিটি হয় তিন বছর আগে। ডা. হুমায়ুন কবির সভাপতি এবং ডা. জি কে দাসকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫১ সদস্যের জেলা এনপিপির কমিটি হয় দুই বছর আগে।

সর্বশেষ খবর