বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

তবুও মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে নারী

জিন্নাতুন নূর

তবুও মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে নারী

কাতারের একটি হাসপাতালে চাকরির কথা বলে বাংলাদেশি কয়েকজন নারীকে বিক্রি করা হয় সেখানকার এক পতিতালয়ে। সেখানে সেই নারীদের বন্দী করে রাখা হয়। এদের মধ্যে এক নারী গত বছর কৌশলে দেশে ফিরে এসে যে দালাল চক্রের মাধ্যমে কাতার গিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তার ভাষ্যমতে, কাজের আশায় কাতারে গিয়ে কয়েকশ বাংলাদেশি নারী দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। একইভাবে কাজের আশায় দুবাইতে গিয়েও কয়েকশ বাংলাদেশি নারী ভয়াবহ যন্ত্রণা ভোগ করছেন। দুবাইয়ের গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেখানে অন্তত ৩০ হাজার বাংলাদেশি নারীকে দেহব্যবসায় বাধ্য করানো হচ্ছে। জানা গেছে, ভালো আচরণ ও মুসলমান হওয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকের বিপুল চাহিদা। তবে নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের কারণে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশ তাদের নারী গৃহকর্মীদের বিদেশে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার হার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। আবার তিন-চার বছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরেছেন। তাদের নির্যাতনের কথা শুনে অনেকেই এখন সেখানে যেতে আগ্রহী নন। আগে যাচাই-বাছাই ও প্রশিক্ষণ ছাড়া এবং নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবেই দরিদ্র নারীরা বিদেশে কাজ করতে যেতেন। কিন্তু এখন নারী

শ্রমিকরা সচেতন। বিশেষ করে নির্যাতনের ভয়ে নারী শ্রমিকরা এখন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণ নিয়ে তবেই যাচ্ছেন। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাজের জন্য বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় বাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। গত বছর সেখানে গেছে ২৪ হাজারের বেশি কর্মী। এরপরে দ্বিতীয় বড় বাজার জর্ডান। সেখানে গেছে প্রায় ২২ হাজার কর্মী। এরপর নারী শ্রমিকদের জন্য অন্য বড় বাজারগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, ওমান, লেবানন ও কাতার। তবে চলতি বছর এই বাজারগুলোর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে নারী কর্মী গমনের হার বেড়েছে। অন্যদিকে কয়েক মাসে জর্ডান, ওমান, লেবানন ও কাতারে নারী কর্মীদের গমনের হার কমে গেছে। বিদেশে যাওয়া নারী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র কোরিয়া-বাংলাদেশ টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে বেশ কয়েকজন নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। এদের অনেকের মধ্যপ্রাচ্যে কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তারা জানান, সেখানে গৃহস্থালি কাজের জন্য তাদের ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না। বিশ্রামও নিতে দেওয়া হয় না। কিন্তু পরিবারকে নিয়ে একটু ভালো থাকার আশায় তারা আবার কোনো মধ্যপ্রাচ্যের দেশে কাজ করতে যেতে চান। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে পাচারের শিকার কয়েকজন নারী জানান, বিদেশে অবস্থানকালে তাদের বৈদ্যুতিক শক, সিগারেটের আগুন দিয়ে ছেঁকাসহ অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। পিপাসা পেলে বাথরুমের পানি ও ক্ষুধা পেলে বাসি-পচা খাবার খেতেন। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের লিবিয়ায় প্রেরণ বন্ধ থাকলেও সেখানে নারী শ্রমিকদের পাঠানো হচ্ছে। নারী শ্রমিকদের অনেকে আবার আফ্রিকা হয়ে সুদান যাচ্ছেন। তাদের প্রথমে ট্যুরিস্ট ভিসায় সুদানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর সেখান থেকে লিবিয়ায় পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বাহরাইনের মতো অনেক দেশে যেখানে লেবার অ্যাটাচি নেই সেখানে নারী শ্রমিকদের বিপদে পড়তে হচ্ছে। তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েও এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। অন্যদিকে লেবার উইংগুলোতে নারী কর্মকর্তা কম থাকায় নারীরা তাদের সমস্যার কথা ঠিকভাবে বলতেও পারেন না। আর ওমানের অনেক বাড়িতে বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা বন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওমানের গৃহকর্তারা বন্দী শ্রমিকদের ওপর যৌন ও শারীরিক নির্যাতন করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মালিকরা গৃহশ্রমিকদের বিশ্রাম ও খাওয়ার সুযোগ না দিয়েই জোর করে কাজ করাচ্ছে। তবুও নারী শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যসহ আরব দেশগুলোতে বেশি যাচ্ছেন। সৌদি আরবের সঙ্গে সরকারের নতুন চুক্তির ফলে সেখানে নারী শ্রমিকের গমন হারও বেড়েছে। সৌদি আরবে নারীরা গৃহকর্মী ও পরিষ্কারকর্মী হিসেবে কাজ করতে যান। কিন্তু সেখানে নারী কর্মীদের নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার হারও কম নয়। মাসিক ১৬ হাজার টাকা বেতনসহ আরও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সৌদি সরকারের সঙ্গে গৃহস্থালি কাজে নারী শ্রমিক প্রেরণের জন্য সরকারের চুক্তি হয়। তবে কাজ করার অল্প দিনেই অনেকে ফেরত আসছেন। সৌদি ফেরত নারী কর্মীদের বেশির ভাগের অভিযোগ, কাজের চাপ যেমন বেশি তেমনি বাড়ির গৃহকর্তা নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশি নির্যাতিত অনেক নারীকেই তারা দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের এক নারী শ্রমিক সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। পরে জীবন বাঁচাতে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়। এ বছরের ৬ এপ্রিল তিনি দেশে ফেরেন। এ ছাড়া যশোরের আরেক নারী সৌদিতে বাসার গৃহকর্তা, তার ছেলে ও ছেলের বন্ধুরা তার ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করত। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি জানান, নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরকালে নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। সরকার এখন মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ছাড়াও নারী কর্মীদের জন্য নতুন বাজার খুঁজছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের চাপ খুব বেশি। সেখানে এক একটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় এক একজন গৃহকর্মীকে রাত-দিনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। এদিকে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতিত নারীদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন।

এদের একজন ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের একজন শ্রমিক। লেবানন ফেরত এই নারী এ বছর আরেক বাংলাদেশি নারীর সহযোগিতায় দেশে ফিরলেও এখন তিনি মানসিক রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর