চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) একের পর এক খুনের মাধ্যমে দীর্ঘ হচ্ছে লাশের তালিকা। রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ, আধিপত্য বিস্তার, অন্তঃকোন্দলকে কেন্দ্র করে এসব খুনের ঘটনা ঘটছে। গত ২৮ বছরে চবিতে ২০ খুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে বিচার হয়নি একটি হত্যাকাণ্ডেরও। সংশ্লিষ্টদের মতে, হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া, মামলার তদন্ত ও বিচারে দলীয় প্রভাব এবং শিক্ষা-কর্মকর্তাদের রাজনীতির কারণে বিগত সময়ে একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারও হয়নি। অপরাধ করেও পার পাওয়ায় উৎসাহিত হচ্ছে অপরাধীরা। ফলে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে।
জানা যায়, ১৯৮৮ সালে তৎকালীন জাতীয় ছাত্রসমাজ নেতা হামিদের হাতের কব্জি কেটে চবিতে রক্তের হোলি খেলা শুরু করে ছাত্রশিবির। এরপর থেকে গত ২৮ বছরে চবিতে ২০টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। সর্বশেষ রবিবার রাতে চবি ক্যাম্পাস থেকে সিলিং ফ্যানে ঝোলানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর লাশ। লাশ উদ্ধারের পর পরিবার ও অনুসারীরা দাবি করছেন, দিয়াজকে খুনের পর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বিগত সময়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের এখনো পর্যন্ত বিচার হয়নি একটিরও। এসব হত্যাকাণ্ডের সিংহভাগেরই মূল কারণ ছিল আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি ও অন্তঃকোন্দল। ১৯৮৮ সালের ২৮ এপ্রিল নগরীর বটতলী স্টেশনে শিবিরের হামলায় নিহত হন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কর্মী পরিসংখ্যান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমিনুল হক। ১৯৮৮ সালে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন আইনুল হক নামে শিবিরের এক কর্মী। ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর শিবিরের হামলায় নিহত হন ছাত্রমৈত্রীর কর্মী ফারুকউজ্জামান। ১৯৯৪ সালের ২৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনের পার্শ্ববর্তী মাজার এলাকায় শিবির ক্যাডারদের হাতে খুন হন ছাত্রদলের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল হুদা মুছা। ১৯৯৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত কটেজে হামলা চালিয়ে খুন করা হয় আবৃত্তিকার বকুলকে। ১৯৯৮ সালের ৬ মে শাহ আমানত হলে শিবিরের হামলায় নিহত হন ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা আইয়ুব নামে এক শিক্ষার্থী। ১৯৯৮ সালের ১৮ মে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের বালুছড়া এলাকায় শহরগামী একটি শিক্ষক-বাসে শিবিরের হামলায় নিহত হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মুশফিক-উস-সালেহীন। ১৯৯৮ সালের ২১ আগস্ট পুরাতন বটতলী স্টেশন এলাকায় ছাত্রশিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে নিহত হন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সঞ্জয় তলাপাত্র। ১৯৯৯ সালের ১৫ মে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন শিবির কর্মী জোবায়ের। একই বছর ১৯ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন শিবির কর্মী রহিমুদ্দিন ও মাহমুদুল হাসান। ২০০১ সালের ২৯ ডিসেম্বর হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ এলাকায় শিবিরের হামলায় নিহত হন ছাত্রলীগের তৎকালীন সিনিয়র সহ-সভাপতি আলী মর্তুজা। ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হন মহিউদ্দিন মাসুম। ২৯ মার্চ ফতেয়াবাদ এলাকায় রেললাইনের পাশে হারুনর রশিদ নামে এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছর ১৫ এপ্রিল নিহত হন আসাদুল ইসলাম নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী। ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে নিহত হন মাসুদ বিন হাবিব ও মুজাহিদুল ইসলাম নামে দুই শিবির নেতা। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি সংঘর্ষ চলাকালে নিহত হন মামুন হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী তাপস সরকার।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে চবিতে ধীরে ধীরে সুস্থধারার রাজনীতি লোপ পেয়েছে। ছাত্রনেতারাও ব্যক্তিস্বার্থে আগের চেয়ে বেশি ব্যবহূত হচ্ছে। শিক্ষক-কর্মকর্তারা ছাত্রদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ দিচ্ছে। তাই চবিতে একের পর এক খুন হচ্ছে।’ সমাজবিজ্ঞানী ও চবির সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. গাজী সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘এসব খুনের পেছনে কতিপয় শিক্ষক ও প্রশাসনের কিছু টেন্ডারবাজ কর্মকর্তার হাত রয়েছে। এসব টেন্ডারবাজকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা না গেলে খুনের সংখ্যা বাড়তে থাকবে।’