শিরোনাম
শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
প্রকৃতি

নোনায় আক্রান্ত সুন্দরবনের বাঘ

মোস্তফা কাজল, সুন্দরবন থেকে ফিরে

নোনায় আক্রান্ত সুন্দরবনের বাঘ

লবণাক্ততা বা নোনায় আক্রান্ত হচ্ছে সুন্দরবনের বাঘ। ফলে বাড়ছে এদের জীবনধারণের ঝুঁকি। চার-পাঁচ বছর আগেও সুন্দরবনের কটকা কিংবা হাড়বাড়িয়ায় বাঘ দেখা যেত। এখন দেখা যায় না। বাঘ বনের অনেক গভীরে সরে গেছে। সব মিলিয়ে সুন্দরবনে নোনার দাপটে প্রতিবেশব্যবস্থায় চিড় ধরেছে।

কয়েক দিন আগে সুন্দরবনে সরেজমিনে গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। নোনার কারণে সুন্দরবনের পরিচয়বাহী বাঘের (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। দিন দিন বাড়ছে এ সংকট। এমনকি বিচরণ এলাকাও কমে আসছে। সুন্দরবনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল ক্রমে বিলুপ্তির পথে। সমুদ্রের পানির স্তর বাড়ার কারণে ভূমিক্ষয় হওয়ায় বনের এলাকা কমছে ও লবণাক্ততা বাড়ছে। বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, সুন্দরবনের বাঘ বাঁচাতে হলে সুন্দরবন এলাকায় ক্যাপটিভ এলাকা চিহ্নিত করে বাঘ শাবকের প্রজনন করতে হবে। তিনি চীনের সঙ্গে তুলনা করে বেসরকারি খাতে বাঘ শাবক আমদানির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। নতুবা চোরা শিকারি ও বনদস্যুর কারণে বাঘ হত্যার মাধ্যমে বাঘ নিধন অব্যাহত থাকবে। বন বিভাগের বন সংরক্ষক অজিত কুমার বলেন, সুন্দরবনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অতিরিক্ত নোনা মাটিতে সুন্দরী গাছ আর বংশ বৃদ্ধি করতে পারছে না। তার জায়গা নিয়েছে বেঁটে এক ধরনের গাছ, যা ভালোভাবে ডালপালা মেলে না। এর ফল হিসেবে সুন্দরবনের সমুদ্রের দিকঘেঁষা বিস্তীর্ণ অংশে জঙ্গল এরই মধ্যে পাতলা হয়ে গেছে। এ ছাড়া সুন্দরবনে বাঘ অঞ্চলের এলাকায় অতিরিক্ত নোনা মাটিতে মাথা তোলা ম্যানগ্রোভের নতুন প্রজাতির গাছগুলোতেও লবণের পরিমাণ অত্যধিক। ফলে তৃণভোজীরা তা মুখে তুলছে না। ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের প্রধান তৃণভোজী প্রাণী হরিণ। এরা খাবার না পেয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। যে কারণে বাঘকেও সরে পড়তে হচ্ছে। সুন্দরবন ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বেডস) নির্বাহী প্রধান মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ এলাকা আমাদের দেশের, যা পূর্বাংশে; আর বাকি ৪০ শতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, যা পশ্চিমাংশ নামে পরিচিত। আমাদের মিষ্টি পানির উৎস হচ্ছে পাহাড়বাহিত নদী ও বৃষ্টি। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়া এবং উজানের নদী থেকে একেবারেই পানি না আসায় জোয়ারের চাপে সাগরের পানি বেশি চলে আসে। ফলে পানিতে আসায় নোনার আধিক্য ধরা পড়ে। উজানের নদীগুলোর পানি ভারত নানাভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আমাদের এখানে মিষ্টি পানির সংকট দেখা দেয়। বছরের বেশির ভাগ সময়ই এখন নোনা পানির দাপট থাকছে। উপরন্তু পশ্চিমাংশে বিদ্যাধরী নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিষ্টি পানির জোগান প্রায় বন্ধ। ফলে নোনার তেজ বাড়ছে। পাশাপাশি বিশ্ব উষ্ণায়ন ও আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বাড়ছে। আর সুন্দরবনের দ্বীপগুলোয় অবাধে সেই নোনা জল প্রবেশ করছে। আবার মাটিতে লবণের পরিমাণ বাড়লে বাইন জাতীয় গাছের সংখ্যা বাড়ে। তার শ্বাসমূল ঘন হওয়ায় বাঘের শিকার ধরতে অসুবিধা হয়।’ তিনি আরও বরেন, বলেশ্বরের পারে কটকা অভয়াশ্রম। সূর্যাস্ত দেখার জন্য স্থানটি মনোরম। পরিবেশ শান্ত থাকলে এখানেই এখনো দেখা মেলে চিত্রা হরিণের। এর পাশেই টাইগার টিলা। এখানে মাঝেমধ্যে বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। সমগ্র সুন্দরবনের মধ্যে এটি উঁচু জায়গা। বনের অন্যান্য অঞ্চল জোয়ারের পানিতে সয়লাব হলেও এ জায়গায় পানি ওঠে না। মাকসুদুর রহমান জানান, জোয়ার ও নোনার দাপটে বনের পশ্চিমাংশ বেশি আক্রান্ত বলে সেখানে বাঘের সংখ্যা কম। পূর্ব সুন্দরবনে উঁচু জায়গা ও নোনার পরিমাণ কম হওয়ায় এখানে বাঘের সংখ্যাও বেশি। আবার আকর্ষণীয় বলে পর্যটকদের আনাগোনাও বেশি। ট্যুর অপারেটররাও কটকা ঘিরে তাদের যাত্রাসূচি ঠিক করেন।

সর্বশেষ খবর