সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাগ-রাগিণীর আবহময় রাত

মোস্তফা মতিহার

রাগ-রাগিণীর আবহময় রাত

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব-২০১৬ এর চতুর্থ রাতে আর্মি স্টেডিয়ামের অগণিত দর্শক-শ্রোতা শাস্ত্রীয় সুরের ইন্দ্রজালে মোহাবিষ্ট ছিলেন। সংগীতাসরে ছিল তাল, লয়, রাগ, ঠুমরি, সরোদ আর খেয়ালের আবহ। যা বিকশিত হয়ে উঠেছিল ধ্রুপদীর অনন্য সুষমাতে। রাগাশ্রয়ী সংগীতের কারিগরদের তবলার তালে, সরোদের হৃদয় হরণ করা সুরে, খেয়ালের রাগে সুরপিয়াসীরা নেশায় বুঁদ   ছিলেন সন্ধ্যা থেকে ভোর ৫টা ১০ মিনিট পর্যন্ত। বিশেষ করে শুরু থেকে রাত যত বেড়েছে, শাস্ত্রীয় সুরের সুধার আলো ততই বিকশিত হয়েছে। গতকাল মূল আকর্ষণ ছিলেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। খেয়ালের সঙ্গে নিজেকে নিমজ্জিত করার পাশাপাশি এ দেশের অগণিত দর্শক-শ্রোতাকে খেয়ালের রাগে, তালে, লয়ে, ছন্দে নিমজ্জিত করেন এই কিংবদন্তি। শাস্ত্রীয় সংগীতের অগণিত সমঝদারের রাগাশ্রয়ী সুরের মোহে আবিষ্ট রেখে সুরের রেশ রেখে দিয়েই নিজের পরিবেশনা শেষ করেন অজয় চক্রবর্তী। তার পরিবেশনার মধ্য দিয়েই চতুর্থ রাতের সমাপনী ঘটে।

এর আগে সন্ধ্যা ৭টায় মুনমুন আহমেদ ও তার দল রেওয়াজ-এর দলীয় কত্থক নৃত্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় চতুর্থ রাতের আয়োজন। কত্থক পরিবেশনায় অংশ নেন ঐশ্বরিয়া রহমান, আনিসা আইরিন আহমেদ, অবন্তিকা আলরেজা, লাভা বিশ্বাস, মাহিমা মেহনাজ আনাম, মাইশা মালিহা খান, মাসুম হুসেন, মো. শামীম আশরাফ, নুসরাত ফাতিমা খান, পারিমিতা রহমান, শারমিন সুহেলি খানম, শর্মিষ্ঠা সোনালিকা সরকার, শিশির বিন্দু বিশ্বাস, সৌদামনি মজুমদার, উজমা সামাদ, জেরিন তাসফিহ্?, রেশমা, কাজী তানিসা জামান, রূপকথা চৌধুরী। রাগ ‘ভিন্ন ষড়জে’ গুরুবন্দনার মধ্য দিয়ে ধ্রুপদী নাচ শুরু করেন তারা। এরপর ত্রিতালে কত্থক পরিবেশন করেন শিল্পীরা। যার প্রথমাংশে ছিল বিলম্বিত লয়ে ঠাট, উঠান, আমাদ ও পরন-আমাদ। পরবর্তীতে মধ্য লয়ে তেজামদ, টুকরা, তেহাই, পরন, পারমিলু ও লাহিড়ি পরিবেশন করেন মুনমুন আহমেদ ও তার দল। দ্বিতীয় অংশে রাগ গৌ মলহারে ঠুমরির সঙ্গেও তারা নৃত্য পরিবেশন করেন। শেষ অংশে দ্রুত লয়ে দুটি পরন এবং যুগলবন্দী পরিবেশন  করেন তারা। নৃত্যের সঙ্গে কণ্ঠে সহযোগিতা করেন তানজিলা করিম স্বরলিপি। বাঁশিতে ছিলেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সরোদে সুনন্দ মুখার্জি, এস্রাজে অসিত বিশ্বাস, তবলায় সুবীর ঠাকুর এবং আবৃত্তিতে অপরাজিতা মুস্তফা ও অহিদুজ্জামান। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসবের স্মারক তুলে দেন প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ চৌধুরী।

এর পরের পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন তবলা বাদক নীলেশ রণদেব। তবলায় তিনি তিনতাল বাজিয়ে মুগ্ধ করেন দর্শকদের। হারমোনিয়াম সহযোগিতায় ছিলেন মিলিন্দ কুলকার্নি। শেষে শিল্পীর হাতে উৎসবের স্মারক তুলে দেন বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম।

নীলেশ রণদেবের তবলার তিনতালের পরিবেশনা শেষে খেয়ালের দ্যোতনায় সুরপিয়াসীদের সুরের সমুদ্রে নিমজ্জিত করেন কিরানা ঘরানার কণ্ঠশিল্পী জয়তীর্থ মেউন্ডি। ভারতীয় রাষ্ট্রপতির হাত থেকে ‘ইয়াং মায়েস্ত্রো ইন মিউজিক’ পুরস্কার পাওয়া এ শিল্পীর পরিবেশনা খেয়ালে ভিন্নতার আমেজ এনে দেয়। রাগ ‘শুদ্ধকল্যাণ’ দিয়ে নিজের পরিবেশনা শুরু করেন এই শিল্পী। এরপর পরিবেশন করেন রাগ ‘আদানা’ সবশেষে ‘নাট্যগীত’ রাগের মধ্য দিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের সুরের মোহে আবিষ্ট রেখে মঞ্চ থেকে নামেন এ শিল্পী। এরপর তিনতালে তবলার যুগলবন্দী পরিবেশনায় সুরের সাগরে ঢেউ তোলেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি ও পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভীষণ উপভোগ্য ছিল তাদের পরিবেশনা। চতুর্থ রাতের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কর্ণাটকি কণ্ঠ সংগীতশিল্পী দুই বোন রঞ্জনি বালসুব্রক্ষ্মণ্যন ও গায়ত্রী বালসুব্রক্ষ্মণ্যনের যুগল পরিবেশনা। শিল্পীদ্বয়ের স্বতন্ত্র্য গায়কী ছুঁয়ে যায় সংগীতপ্রেমীদের মন।   পরবর্তী পরিবেশনায় সরোদের শৈল্পিকতায় সমগ্র আর্মি স্টেডিয়ামে তন্ত্রমুগ্ধের আবহ তৈরি করেন পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। স্বনামধন্য সরোদিয়া তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের কৌশলগত দক্ষতা এবং ধ্রুপদ, তন্ত্রকারী ও বিভিন্ন গায়কীর উপাদানে সমুজ্জ্বল ছিল পরিবেশনাটি। চতুর্থ রজনীর শেষ পরিবেশনা ছিল এই উচ্চাঙ্গ সংগীত আসরের অনেকটাই নিয়মিত শিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল।

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের এবারের আসর নিবেদন করছে স্কয়ার এবং সহযোগিতায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক। এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব-২০১৬ এর নিবেদক স্কয়ার গ্রুপ। আয়োজন সমর্থন করছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। এ বছর উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) স্মৃতির উদ্দেশ্যে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর