শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভেঙে পড়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

দেখা নেই ট্রাফিক বাতির, অকার্যকর গতিরোধক

জিন্নাতুন নূর

ভেঙে পড়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

ঢাকার নৌবাহিনী সদর দফতরের সামনের প্রধান সড়কে একটি স্পিড ব্রেকার বা গতিরোধক আছে। কিন্তু এর ওপর এখন কোনো সাদা-কালো চিহ্ন বা রং নেই। যান চলাচলে তা বহু আগেই উঠে গেছে। এ সড়কে যারা নিয়মিত নন এমন কোনো চালক এই গতিরোধকের কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেন না যে এখানে একটি গতিরোধক আছে। বিশেষ করে রাতের বেলা দ্রুতগামী কোনো যান ও মোটরসাইকেল প্রায়ই অসচেতন থাকায় দ্রুত এই গতিরোধকটি পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। কয়েকদিন আগে মধ্যরাতে একটি মোটরসাইকেল এই গতিরোধকটি খেয়াল করতে না পারায় শেষ মুহূর্তে এসে ব্রেক কষতে গিয়ে সহযাত্রীসহ উল্টে পড়ে আহত হন। রাজধানীর ফার্মগেটের ব্যস্ততম সড়কে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নাছিমা বেগম তার সন্তানদের নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন যানচলাচল বেশি ছিল। রাস্তা পার হওয়ার জন্য নাছিমা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। তিনি যাবেন মনিপুরিপাড়া। ফার্মগেট মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের বাতির দেখা মিললেও ধূলিধূসর ও জরাজীর্ণ বাতিগুলো সক্রিয় ছিল না। ফলে ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে যখন গাড়ি থামার সিগন্যাল দেন তখনই সন্তানদের নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়ান নাছিমা। অন্যদিকে ফার্মগেট হয়ে বিজয় সরণির দিকে যাওয়ার রাস্তায় গতিরোধকের সাদা-কালো রং উঠেছে বহু আগে। গুরুত্বপূর্ণ এই মোড়ে পথচারীরা অনেকটা গতিরোধকের ওপর দিয়ে কখনো সড়কের ওপর দিয়ে আন্দাজেই সড়ক পার হন। গতিরোধকের রং উঠে যাওয়ায় পথচারীদের পক্ষেও ঠিক কোন স্থান দিয়ে তারা সড়ক পার হবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ইসিবি চত্বরের কাছে ব্লু মুন চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে কিছুদিন আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় এক পথচারী প্রাণ হারান। এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রাস্তার উভয় পাশে গতিরোধক তৈরি করে। কিন্তু এই সড়কে যানচলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় গতিরোধকের চিহ্ন কিছুদিনের মধ্যেই ঝাপসা হয়ে যায়। ফলে দূর থেকে দ্রুতগতিতে আসা কোনো গাড়ির পক্ষে হঠাৎ করে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না যে এখানে কোনো গতিরোধক আছে কিনা। আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মোড় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ সড়কের জেব্রা ক্রসিং, গতিরোধকের রং উঠে গেছে। এগুলোর কতগুলোতে আংশিক রং থাকলেও তা না থাকার মতো। এমনকি এগুলো দীর্ঘদিন ধরে রংবিহীন থাকলেও দেখার কেউ নেই। দেখা যায়, ঢাকার মতিঝিল, পল্টন, ফার্মগেট, শাহবাগ, বনানী, আসাদগেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও মহাখালীসহ অন্যান্য সড়কের গতিরোধকের রং উঠে গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ট্রাফিক মোড়ে লাগানো লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের সিগন্যাল বাতিগুলোও অকেজো হয়ে পড়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে বাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ না করায় বেশিরভাগই এখন নষ্ট হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু ভেঙে ঝুলে আছে। এ অবস্থায়  যানবাহনের ফাঁকে ফাঁকে পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার করতে দেখা যায়।

২০১৫ সালে শহরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করা হলেও এটি তেমন কাজে আসেনি। ফলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে এখনো পুলিশকে বাঁশি ও হাতের ইশারায় কাজ করতে হচ্ছে। যানজট নিরসনে ‘ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর ৭০টি মোড়ে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানো হয়। ২০০৯ সালের নভেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে স্বয়ংক্রিয় এই সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করা হলেও অল্পদিনের মধ্যেই তা শিথিল হয়ে যায়। পুলিশের দাবি, এসব সিগন্যাল বাতি অল্প দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পুরনো পদ্ধতিতে ফিরতে তারা বাধ্য হয়েছেন। তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ এর পেছনে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের দ্বন্দ্বই প্রধান কারণ। বর্তমানে ঢাকায় আধা স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থায় ট্রাফিক পুলিশ যান নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ পদ্ধতিতে হাতে থাকা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে যে সড়কে যানবাহনের চাপ বেশি সেখানে সবুজ বাতি জ্বালানো হয়। আর অন্য সড়কে তখন লাল বাতি জ্বলে। ভেঙে পড়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা।

ট্রাফিক বিভাগের ডিসি (উত্তর) প্রবীর কুমার রায় বলেন, সিটি করপোরেশন ও ডিএমপি ট্রাফিক পুলিশ শিগগিরই নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। তবে আমাদের কাজ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার নয়, এটি সিটি কর্পোরেশনের কাজ। আমরা সড়কে কেউ আইন ভঙ্গ করল কিনা সে বিষয়টি তদারকি করি। কোথাও কোনো অব্যবস্থাপনা হলে সে কাজের দায়িত্ব শুধু ট্রাফিক পুলিশের একার নয়। তবে ব্যস্ত সড়কে সুষুম ব্যবস্থাপনা বজায় রাখতে ট্রাফিক পুলিশ, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ও পথচারী সকলেরই সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে।    

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য আগামী বছরের মধ্যে ৬৫টি সিগন্যাল টাইমার কাউন্টডাউন যন্ত্র স্থাপনের কাজ শেষ হবে। আর এর ব্যবহার হলে বর্তমানের চেয়ে অন্তত ১০ ভাগ ট্রাফিক মোবিলিটি বৃদ্ধি পাবে। কোন ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি কতক্ষণ থাকবে তা ওই সিগন্যালের পুলে স্থাপিত টাইমার কাউন্টডাউন যন্ত্রে ভাসতে থাকবে। নির্দিষ্ট সময় থেকে কাউন্টডাউন করে শূন্যে নেমে আসার পর সবুজ বাতি জ্বলার সঙ্গে সিগন্যাল থেকে গাড়িগুলো ছেড়ে যেতে পারবে। জানা যায়, পিক আওয়ারে সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা এবং বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ২ মিনিট পর সিগন্যাল পড়বে। অফপিক আওয়ারে সকাল ৬টা থেকে ৮টা, বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৪টা এবং রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আড়াই মিনিট পর পর স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পড়বে।

সর্বশেষ খবর