বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ভূত সরকারি দফতরে

মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ণয় হলো না ৪৬ বছরেও

মানিক মুনতাসির

আবদুন নোমান। সহকারী প্রকৌশলী। সড়ক ও জনপদ অধিদফতরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি করছেন ২৩ বছর। কিন্তু তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া চিহ্নিত হওয়ার কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও তিনি নিজ পদে বহাল রয়েছেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে আবদুন নোমানের বিষয়ে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করা হয়। তার মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিষয়ে মন্ত্রী একাধিকবার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেন। কিন্তু আবদুন নোমান মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকরি নিয়ে আজও স্বপদে বহাল রয়েছেন। এমন অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এখনো সরকারি বিভিন্ন দফতরে কর্মরত বলে জানা গেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ চলছে প্রায় সাত বছর ধরে। এর আগে ২০০৯ সালের ১৩ মে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তখন থেকেই শুরু হয় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করার কাজ। এর অংশ হিসেবে সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তাকে চাকরিও ছাড়তে হয়। অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনো নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করতে পারেননি নানা কারণে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শুদ্ধ তালিকা প্রকাশের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এ নিয়ে কাজ করছে। যাচাই-বাছাইয়ের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। আগামী জানুয়ারিতে আবার শুরু হবে। এক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে কারও নাম বাদ পড়লে তিনি আপিল করার সুযোগ পাবেন। আর যিনি নতুনভাবে যুক্ত হবেন তার ব্যাপারেও যদি কোনো অভিযোগ আসে তাও খতিয়ে দেখা হবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। রাজনৈতিক মতভেদ, তথ্যপ্রমাণের ঘাটতিসহ নানা কারণে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি কোনো সরকারই। ফলে সরকারি বিভিন্ন দফতরে এখনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট রয়ে গেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বীরাঙ্গনাদের সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই-বাছাই, চিহ্নিত করা এবং নতুন মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে। তবে আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। যদিও এ ধরনের ঘোষণা আরও একাধিকবার দিয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী।  মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য নতুন করে ১ লাখ ২৩ হাজার আবেদন জমা পড়ে। সেগুলোই যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছিল। কিন্তু বর্তমান তালিকা এবং পূর্বের তালিকাসহ পুরো প্রক্রিয়াতে এক ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। ফলে বর্তমানে সে কাজ বন্ধ রয়েছে। ২০১৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী প্রায় ৫০ হাজার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। উপজেলা পর্যায়ের কমিটি দিয়ে এগুলো যাচাই করা হবে। এর জন্য উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনে একটি নীতিমালাও করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করে সফটওয়্যারের মাধ্যমে তা তথ্যভাণ্ডারে যোগ করা হবে। এ কাজটি শেষ হলে সবাইকে সনদ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত দলিলের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার ও সাব-সেক্টর কমান্ডারের প্রকাশিত বইয়ে নিয়মিত বাহিনীর ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর ১ লাখ ৭ হাজারসহ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়। আর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জানায়, ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের চার-পাঁচটি তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা চূড়ান্ত রূপ পায়নি। এমন কি বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর যে নতুন করে উদ্যোগ নেয় তাও এখন থেমে গেছে।  এ বিষয়ে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করতে হলে মুক্তিযুদ্ধকালীন সশস্ত্র যোদ্ধা, গেরিলা যোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক সংগঠক ও ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে প্রকৃতদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া সশস্ত্র, গেরিলা, শিল্পী, সহযোগী, কূটনৈতিক প্রশিক্ষকসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় যে যে সেক্টরে অবদান রেখেছেন তাদের নামের শেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভাগকেও রাখা যেতে পারে। এদিকে সম্প্রতি টাঙ্গাইলে সিরাজুল ইসলাম সিদ্দিকী (৬০) নামে এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে সনদ জাল করার অপরাধে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করা ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের দফতরে জমা দিয়ে খোদ মন্ত্রীর কাছেই ধরা পড়েছেন এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। মন্ত্রী নিজেই তাকে মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশে সোপর্দ করেন। ভুয়া ওই মুক্তিযোদ্ধার নাম মো. মোজাফফর হোসেন। সর্বশেষ চারদলীয় জোট আমলে ৭২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকায় সন্নিবেশিত করা হয় বলে জাতীয় সংসদে অভিযোগ তোলেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম। এরপর ২০০৯ সালের ১৩ মে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেই যাচাই-বাছাইয়ের কাজও এখন বন্ধ রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে সারা দেশে প্রায় দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তবে এর সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করতে হলে আরও সময়ের প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর