মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

শ্রমিকদের ৫ দাবি

পোশাক শিল্পের সংকট উত্তরণ

রুহুল আমিন রাসেল

দেশে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা তাদের চলমান সংকট উত্তরণে সরকার ও মালিকদের কাছে ৫ দফা দাবিনামা উত্থাপন করেছেন। এগুলো হলো— মোট মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ, রেসনিং প্রথা চালু, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণ। এই সঙ্গে শ্রম আইন ও বিধিমালায় শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারা পরিবর্তন এবং অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করার দাবিও করা হয়েছে।

ওয়াকিফহালদের তথ্যানুযায়ী, গত চার দশকে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম অংশীদার পোশাকশিল্প দেশের আর্থ-সামাজিক     উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে আসছে। মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগ অর্জনকারী এই শিল্পের উদ্যোক্তারা আগামী ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করতে চাইছেন। তবে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে তাদের মজুরি কতটুকু বাড়বে, তার কোনো দিকনির্দেশনাই নেই সরকার ও মালিক পক্ষে। ফলে শ্রমিকদের জীবন-যাপনে চলছে চরম অভাব-অনটন ও দরিদ্রতায়। অনবরত রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন অসংখ্য শ্রমিক। শ্রমিক সংগঠনগুলো জানিয়েছে, শ্রমিকদের জীবনধারণ উপযোগী ন্যায্য মজুরি নেই। রেশনিং, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকদের প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা ও অন্যান্য ছুটি প্রদান করা হয় না। উৎসবভাতা, গ্র্যাচুইটি নেই। চাকরি শেষে সার্ভিস বেনিফিট প্রদান করা হয় না। এমন প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রেখে পোশাকশিল্প বিকশিত করতে এবং জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে ন্যূনতম মূল মজুরি ১০ হাজার টাকাসহ মোট মজুরি ১৬ হাজার টাকায় উন্নীতকরণ জরুরি প্রয়োজন। অন্যদিকে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের ও পোশাকশিল্প খাতে উল্লিখিত দাবি পূরণের সক্ষমতা আছে কিনা— তা বিবেচনায় নিতে হবে। দেশি-বিদেশি বাস্তবতাও মানতে হবে। তারপরও মালিকরা অনেক কষ্ট করে প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দিচ্ছেন— এটাও সবার বিবেচনায় আনা উচিত।’  এ প্রসঙ্গে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, ‘মালিকরা অযৌক্তিক কথা বলছেন। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর মতো সব অবস্থা দেশে তৈরি হয়েছে। তাদের জীবন-যাপনের সব ব্যয় বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এমন সব বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে অবলম্বে মজুরি বোর্ড গঠন করে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হোক।’ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলেই চাকরিচ্যুতির শিকার হচ্ছেন। দেশে সাম্প্রতিক চার শতাধিক পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হলেও, মালিকরা তার স্বীকৃতি দেননি। বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো খুবই জরুরি। এ জন্যে গত ২০ ডিসেম্বর আমরা একটি দাবিনামা প্রধানমন্ত্রী, শ্রম প্রতিমন্ত্রী, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সভাপতির কাছে প্রেরণ করেছি।’ শ্রমিক সংগঠনগুলো আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় কম। বর্তমান মজুরিতে খেয়ে পরে বেঁচে থেকে শ্রমিকদের পক্ষে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিকদের জীবনের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে।

মন্ত্রী, এমপি, আমলা, সরকারি, চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। শ্রম আইনে ৩ বছর পর মজুরি বাড়ানোর আইনি বিধান আছে। বিগত ২০১৩ সালে মজুরি বাড়ানোর সময়েই ৩ বছর পর পুনরায় মজুরি বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন মালিকরা। এমন প্রেক্ষাপটে সারা দেশের সব গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো অতি জরুরি। এ সব বিবেচনায় নিয়ে সরকার ও মালিকপক্ষের কাছে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের উত্থাপিত দাবিগুলো হলো— শ্রমিকদের ন্যূনতম মূল মজুরি ১০ হাজার টাকা, বাড়ি ভাড়া ৪ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার টাকা এবং যাতায়াত ভাতা ১ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করতে হবে। এর সঙ্গে সোয়েটার কারখানায় পিসরেটসহ সব শ্রমিকদের একই হারে মজুরি বাড়াতে হবে। এ জন্যে অতিসত্বর মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। গ্রেফতারকৃত শ্রমিক ও নেতাদের মুক্তি দিতে হবে। সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের পুনর্বহাল করতে হবে। বেআইনিভাবে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধকালীন সময়ের মজুরি দিতে হবে। শ্রমিকদের কারখানাভিত্তিক রেশনিং প্রথা চালু করে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রদান করতে হবে। শ্রমিকদের বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রম আইন ও বিধিমালার শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারা পরিবর্তন করে বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইএলও কনভেনশন অনুসারে শ্রমআইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসারে শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করে সংঘবদ্ধ হওয়া, পছন্দমতো সংগঠন করা, দাবিনামা উত্থাপন, দরকষাকষি এবং ধর্মঘট করার অবাধ অধিকার দিতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর