যশোরের বকচর গ্রামের মেয়ে শিলা (ছদ্মনাম)। নাচে আগ্রহ থাকায় ছোটবেলায়ই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রতিবেশী এক নারী শিলাকে ভারতের মুম্বাইয়ের বিনোদন জগতে কাজ করার স্বপ্ন দেখান। সেই নারীর স্বামী শিলাকে মুম্বাই নিয়ে যাবেন বলে জানান। এরপর শিলা ও আরেকটি মেয়েকে সেই নারী ও তার স্বামী বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ওপারে নিয়ে যান। এরপর মহারাষ্ট্রের নাসিকের একটি ড্যান্স বারে শিলাদের নেওয়া হয়। সেখানে ছোট একটি রুমে বাংলাদেশ ও নেপালের আরও ১৫ মেয়ের সঙ্গে শিলাদের আটকে রাখা হয়। আটক মেয়েদের যৌন পেশায় ব্যবহারের জন্য খদ্দেরদের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। আর যারা এতে রাজি হতো না তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতর করা হতো, তাদের অভুক্তও রাখা হতো। এর ঠিক এক মাসের মাথায় শিলার পরিবারের সন্দেহ হলে স্থানীয় একটি এনজিওর মাধ্যমে তারা থানায় মামলা করেন। খদ্দেরের কাছে বিক্রির মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ভারতীয় পুলিশ শিলাকে উদ্ধার করে। ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। পতিতালয় থেকে উদ্ধারের পরও আপনজনদের কাছে ফিরে আসার আগে ভারতে এক বছর শিলাকে থাকতে হয়েছিল। ফিরে এসে পাচারের বিষয় লুকিয়ে বিয়েও করেছেন শিলা। তার সন্তানও আছে। কিন্তু অতীতের ভয়াবহ স্মৃতি কখনই ভুলতে পারবেন না বলে এই প্রতিবেদককে জানান। পাচারের শিকার একই গ্রামের আরেক মেয়ে সায়মা (ছদ্মনাম)। মাত্র পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভারতে গৃহকর্মীর কাজ দেওয়ার কথা বলে গ্রামের এক পরিচিত ব্যক্তি তাকে ভারতে পাচার করেন। পরে মুম্বাইয়ের একটি পতিতালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মালিকের কথা না শুনলে তার গায়ে হাত তোলা হতো। পাচারের ছয় মাসের মাথায় সায়মাকে উদ্ধার করা হয়। দেশে ফিরে শিলার মতোই পাচারের বিষয় লুকিয়ে বিয়ে করেন। সায়মা জানান, এই গ্রামের পাচারকৃত মেয়েরা যশোরের স্থানীয় একটি এনজিওর সহযোগিতায় দেশে ফিরে এলেও নিজেদের পাচার হওয়ার বিষয়টি সবাই গোপন রেখেছেন। কিন্তু সব মেয়ে শিলা-সায়মাদের মতো সৌভাগ্যবতী নন। উদ্ধার হয়ে দেশে ফিরে আসার তাদের নানা কটুকথা শুনতে হয়। পরিবার তাদের আর গ্রহণ করতে চায় না। পরিবারের কাছে তারা এক ধরনের বোঝা, স্বজনদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত। এজন্য বাধ্য হয়ে অনেকেই পরিবার ছেড়ে শহরে কাজের আশায় চলে যান। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতে উদ্ধারের পর ভিকটিম ভেরিফিকেশনসহ বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ফলে ভারতের শেল্টার হোমগুলোয় অনেক বাংলাদেশি মেয়ে দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন। এমনকি আগের তুলনায় ভারতের মুম্বাইয়ে বাংলাদেশি যৌনকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের ‘প্রেরণা’ নামের এনজিওর সূত্রে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা পাচারের শিকার হচ্ছেন। একটি শিশু কেন্দ্রে ভর্তি ২১৩ যৌনকর্মী শিশুর মধ্যে ১২৮ জনের মা বাংলাদেশি। জানা যায়, বাংলাদেশি ভিকটিমরা আইন সম্পর্কে না জানায় এবং ভীত হওয়ায় উদ্ধারের পরও পতিতালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করতে চান না। এজন্য তারা আইনি সহযোগিতাও কম পান। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের ২০১৬ সালের মানব পাচার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সীমান্তের পুলিশ, রাজনীতিবিদ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী পাচারকাজ পরিচালনার জন্য একটি টোকেন ব্যবহার করে, যার মাধ্যমে পাচারকারীরা পালিয়ে যেতে পারেন। ২০১৫ সালে উদ্ধার করা পাচার ভিকটিমের মধ্যে ৩১৫ জন নারী এবং ১৯০টি শিশু ছিল। এ সংখ্যা গত বছরের চেয়ে কম। যদিও পাচারের শিকার ভিকটিমদের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলা আছে; কিন্তু কার্যত ভিকটিমদের সে ধরনের কোনো সেবা নিতে দেখা যায় না। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের পুলিশ ভিকটিম চিহ্নিতকরণ কাজটি করতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে। অনেক সময় তারা ভিকটিমের পরিবারের কাছে টাকাও দাবি করে। বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশকে বলা হয় মানব পাচারের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট। প্রতি বছর এখান থেকে হাজার হাজার মানুষ পাচার হয়। আর পাচার হওয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই নারী-কিশোরী। যারা পাচারের পর বিদেশে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনকারীদের কাছে মানব পাচার সহজে এবং অল্প সময়ে ধনী হওয়ার একটি পথ। অতিরিক্ত মুনাফা এবং এ-সংক্রান্ত আইনে শাস্তি তেমন কঠোর না হওয়ায় পাচারকারীদের এ অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। গবেষণা ও পাচারসংক্রান্ত বিষয়ে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচার ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বাংলাদেশ হয়ে প্রথমে ভারতের মুম্বাই এরপর পাকিস্তানের করাচি হয়ে বাংলাদেশি নারী-কিশোরীরা চলে যাচ্ছেন দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। জানা যায়, স্থানীয় পাচারকারীরা দেশের ১৬ জেলার ২০টি ট্রানজিট পয়েন্ট ব্যবহার করে নারী, শিশু ও কিশোরীদের পাচার করছেন। যার উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই যাচ্ছেন ভারতের বিভিন্ন স্থানে। সম্প্রতি জলপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশেও মানব পাচার হচ্ছে। ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের গত ১৮ মাসের প্রতিবেদন বলছে, এই সময়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে নৌকা ও জাহাজে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশিকে পাচার করা হয়; যার মধ্যে নারী, শিশু ও কিশোরীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের অন্য প্রতিবেদন জানায়, পাচার হওয়া শিশু-কিশোরীর মধ্যে ৯০%কেই জোরপূর্বক দেহব্যবসায় জড়িত করা হচ্ছে। দেশের মোট পাচারের ১৩.৮ শতাংশই কলকতার পতিতালয়ে রয়েছে। একশ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সি, ট্রাভেল এজেন্সি, স্থানীয় আবাসিক হোটেল মালিক ও কর্মচারী, বিদেশি পতিতালয়ের এজেন্ট ও বস্তির মস্তানরা পাচারের সঙ্গে জড়িত। মূলত দেশ থেকে যে নারীদের গৃহকাজের কথা বলে পাচার করা হয় তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যককেই পরে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব নারী শ্রমিক বিভিন্ন রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে লেবানন ও জর্ডানে গৃহশ্রমের জন্য যান তাদের পরে সিরিয়ায় পাচার করে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের প্রতিবেদন আরও বলছে, বাংলাদেশে মানব পাচার প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। যদিও আগের চেয়ে পাচারসংক্রান্ত অনুসন্ধান কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য সরকার ২০১৫-১৭ সালের জন্য জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। আর ভিকটিমদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ড্রপ-ইন সেন্টার ও সেফ হোম তৈরিতে অর্থায়ন করছে। কিন্তু দেশে ফিরিয়ে আনার পর এই ভিকটিমদের পুনর্বাসনে তেমন সহযোগিতা এখনো সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে না।