সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
পঞ্চগড়ের রাজনীতির হালচাল

আওয়ামী লীগে ঠাণ্ডা লড়াই অভিভাবকহীন বিএনপি

মাহমুদ আজহার ও সরকার হায়দার, পঞ্চগড় থেকে

দেশের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক জেলা পঞ্চগড়। এখানে প্রতিহিংসার রাজনীতি কম থাকলেও দলগতভাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রকাশ্যে কোন্দল না থাকলেও আওয়ামী লীগের ভিতরে চলছে এক ধরনের ঠাণ্ডা লড়াই। একাংশের নেতৃত্বে নূরুল ইসলাম সুজন এমপি, আরেকাংশে মজাহারুল হক প্রধান। আবার জেলার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাটের নেতৃত্বেও পৃথক একটি বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরেই নেতৃত্বে শূন্যতা চলছে বিএনপিতে। দলটি এখন অভিভাবকহীন। আগামী কমিটিকে ঘিরে দুটি বলয় কাজ   করছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের ঘনিষ্ঠভাজন এম এ মজিদ এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আরেকাংশে রয়েছেন পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র তৌহিদুল ইসলাম। অবশ্য বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ফরহাদ হোসেন আজাদ উভয় গ্রুপের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছেন। জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির একাংশের সাধারণ সম্পাদক এমপি নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বেই চলছে জাসদের রাজনীতি। এদিকে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে জাতীয় পার্টির ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আর মামলা-হামলায় কাবু নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতের রাজনীতি। তবে তরুণদের একটি অংশ শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে জাগপার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত।  স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, জেলা আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব নিয়ে গোপনে স্নায়ুযুদ্ধ থাকলেও নেতা-কর্মীরা আগের চেয়ে উজ্জীবিত। দীর্ঘ দশ বছর পর ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হন পঞ্চগড়-২ আসনের এমপি নূরুল ইসলাম সুজন। সাধারণ সম্পাদক পদে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট এবং সাবেক এমপি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মজাহারুল হক প্রধান সমান সংখ্যক ভোট পান। ফলে তাত্ক্ষণিকভাবে সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়নি। এরপর  ১৫ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আনোয়ার সাদাত সম্রাটকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অনুমোদন  দেওয়া হয়। আর মজাহারুল হক প্রধানকে  করা হয় জেলার জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা জানান, এরপর থেকে এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা মজাহারুল হক প্রধান কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। শুরু হয় নতুন করে অন্তর্দ্বন্দ্ব। ভিতরে ভিতরে ত্রিধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে দলটি। দলীয় কার্যক্রমে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিতে দেখা গেলেও ক্রমেই অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে। সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনে এর প্রভাব দেখা গেছে। নির্বাচনে সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক জেলা কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক আবু বকর ছিদ্দিককে জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয়। তিনি ছিলেন মজাহারুল হক প্রধান সমর্থিত প্রার্থী। কিন্তু ভোটে হেরে যান তিনি। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপি নূরুল ইসলাম সুজনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। গণমাধ্যমকে ছিদ্দিক জানান, নূরুল ইসলাম সুজন বিদ্রোহী প্রার্থী সারোয়ার হোসেনকে সমর্থন দিয়েছেন। একই অভিযোগ করেন সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাটের বিরুদ্ধেও। এরপর থেকেই ওই দ্বন্দ্ব এখনো চলছে। এ প্রসঙ্গে নূরুল ইসলাম সুজন ও আনোয়ার সাদাত সম্রাট অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে আবু বকর ছিদ্দিকের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ভোটাররা তাকে গ্রহণ করেননি।’ এদিকে আগামী সংসদ নির্বাচনে পঞ্চগড়-২ (বোদা ও দেবীগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগের সহ-সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শাহজাহান (অব.)। গত ৯ জানুয়ারি পঞ্চগড়ে বিশাল শোডাউন করেছেন। তিনিও তার অনুসারী নেতা-কর্মী সৃষ্টিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির উজ্জ্বল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘পঞ্চগড় আওয়ামী লীগে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সব নেতা-কর্মী বর্তমান কমিটির প্রতি অনুগত থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা রয়েছে। এটা ভালো দিক। এতে দক্ষ নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে।’ বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জেলা কমিটি  নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। একদিকে ক্ষমতাসীনদের নানামুখী চাপ অন্যদিকে নিজেদের গ্রুপিংয়ে বিএনপির অবস্থা হ-য-ব-র-ল। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, নতুন কমিটি না দেওয়া হলে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের দলে ধরে রাখাই কষ্ট হবে। জানা যায়, দীর্ঘ সাত বছর ধরে পঞ্চগড় বিএনপির বিদ্যমান গ্রুপিংয়ের অবসান ঘটাতে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার স্থানীয় সব নেতাকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। এরপর গত ১১ ডিসেম্বর ঢাকার ধানমন্ডির ইয়াকুব সাউথ সেন্টারে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নওশাদ জমিরের  কার্যালয়ে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। সেখানে অংশ নেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। উভয় গ্রুপকে এক করে শিগগিরই কমিটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত জেলা কমিটির কোনো খবরই নেই। জেলার নেতৃত্বশূন্যতার প্রভাব পড়ছে উপজেলা ও ওয়ার্ড পর্যায়েও। একইভাবে অঙ্গ সংগঠনগুলোও ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। জানা যায়, তৃণমূল বিএনপির পুনর্গঠন নিয়ে কাজ করছে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এরই অংশ হিসেবে পঞ্চগড়ের কমিটি নিয়েও ভাবছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ব্যারিস্টার নওশাদ জমিরের নেতৃত্বে জেলা কমিটি দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এ ছাড়াও কমিটির শীর্ষ নেতৃত্বে আলোচনায় রয়েছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ফরহাদ হোসেন আজাদ, পৌর মেয়র তৌহিদুল ইসলাম ও জেলার যুগ্ম সম্পাদক এম এ মজিদ। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, শিগগিরই জেলাসহ উপজেলা পর্যায়ের কমিটি ঘোষণা করা উচিত। একইসঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ অঙ্গ সংগঠনগুলোর কমিটি দেওয়াও জরুরি। এ দিকে দুই দলের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টায় জাগপা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (নাজমুল-আম্বিয়া)। তরুণদের একটি বড় অংশ এখনো জাগপার রাজনীতি করছেন। ২০-দলীয় জোট থেকে পঞ্চগড়ে শফিউল আলম প্রধানকে মনোনয়ন দেওয়া হবে এমন প্রত্যাশাও সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের। অন্যদিকে গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবু  সালেককে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন ’৯০-এর ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাজমুল হক প্রধান।  নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নির্বাচনী এলাকার  আনাচে কানাচে  ঘুরে  নিজস্ব জায়গা তৈরির চেষ্টা করছেন তিনি। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের নির্বাচনেই প্রার্থী দিয়ে এখন দাপটের সঙ্গে অংশ নিচ্ছে নাজমুল হক প্রধানের এই দল। এ প্রসঙ্গে নাজমুল হক প্রধান এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘আমার সংসদীয় এলাকায় কাজ করতে চাই। মূলত কাজই মানুষকে এগিয়ে নেয়, অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখে। পঞ্চগড় জাসদে কোনো কোন্দল নেই। তাই জনগণের আস্থা পাচ্ছি।’

সর্বশেষ খবর