সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

টিফিনে খাচ্ছে ফাস্টফুড-পথখাবার

জিন্নাতুন নূর

টিফিনে খাচ্ছে ফাস্টফুড-পথখাবার

স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও নগরের স্কুল শিক্ষার্থীরা ক্লাস বিরতি এবং স্কুল ছুটির পর অস্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিহীন খাবার খাচ্ছে। বাড়ির খাবারের বদলে তারা স্কুলের সামনে বসা হকারের পথখাবার ও ফাস্টফুড জাতীয় খাবারের প্রতিই বেশি আগ্রহী। ফলে ক্ষতিকর খাবার গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ শিশুদের শৈশব শুরু হচ্ছে। একদিকে সন্তানের ক্ষুধা মেটাতে কর্মজীবী মায়েদের অনেকেই সন্তানকে বাইরের খাবার কিনে খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন, আরেক দিকে শিশুদের বাসায় তৈরি খাবার দেওয়া হলেও স্কুল ছুটির পর অনেকেই অভিভাবকদের না জানিয়ে ক্ষতিকর খাবারগুলো খাচ্ছে। আর পচা, বাসি, ধুলা-বালি এবং রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত এসব খাবার খেয়ে তারা হয়ে পড়ছে অসুস্থ। চিকিৎসকরা বলছেন, উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত ফাস্টফুড আসক্তির কারণে অনেক শিশুই স্থূল হয়ে পড়ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকার কর্মজীবী মায়েরা সকালে কাজে যাওয়ার আগে সময় বাঁচাতে বাচ্চাদের ফাস্টফুড কিনে দিচ্ছেন। কেউ কেউ সন্তানকে টিফিনের জন্য টাকা দিয়ে স্কুলে পাঠাচ্ছেন। আর দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় শিক্ষার্থীরাও ক্লাস বিরতিতে পথখাবার ও ফাস্টফুড বেছে নিচ্ছে। এদিকে বিক্রি বেশি হওয়ায় নগরীর স্কুলগুলোর সামনেই গড়ে উঠেছে স্থায়ী-অস্থায়ী অসংখ্য খাবারের দোকান। এসব দোকানে থাকছে আচার, চটপটি, পেটিস, আইসক্রিম, বার্গার, সমুচা, চপ, পিত্জা, নুডুলস, ভেলপুরি, চপ, পানিপুরি, ঝালমুড়ি, গোলা, হালিম এবং ক্রিম রোলসহ নানা ধরনের খাবার। স্কুলের বাইরে থাকা হকারের খাবারগুলো খোলা অবস্থায় বিক্রি হওয়ায় এতে মাছি বসছে, ধুলা-বালি পড়ছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অভিযান থেকে জানা যায়, বিভিন্ন স্কুলের সামনে বিক্রি হওয়া শিশুখাদ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিষাক্ত ফরমালিন, নিম্নমানে রং, সোডা, স্যাকারিন, মোম, আটা-ময়দা, সুগন্ধি, ট্যালকম পাউডার, পচা বড়ই, তেঁতুল, আম, আমড়া ও ঘনচিনি ইত্যাদি ব্যবহার করছে। স্কুলের দোকানের পাশে গড়ে ওঠা ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে আগের দিনের অবিক্রীত বাসি খাবারও দেদার বিক্রি হচ্ছে। এগুলো খেয়ে শিশুরা ডায়রিয়া, জন্ডিস ও পেটের পীড়ায় ভুগছে। চিকিৎসকদের মতে, ফাস্টফুডের কারণে শিশুদের অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিক স্থূলতা ঘটছে, এবং এ কারণে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনিরোগসহ কয়েক ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সরেজমিন বেইলি রোডে রাজধানীর ভিকারুনন্নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৫ম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীকে সম্প্রতি স্কুল ছুটির পর স্কুলটির সামনে বসা এক হকারের থেকে ভেলপুড়ি কিনে খেতে দেখা গেছে। যদিও সেই ভেলপুরির ওপর প্রচুর মাছি উড়ছিল। জানা গেছে, নগরীর অন্য স্কুলগুলোর সামনে বসা হকারদের বিক্রি করা খাবারগুলোর মানও ভালো নয়। বেশ কয়েকটি স্কুলের সামনে থাকা চটপটি বিক্রেতাদের ময়লা পানিতেই প্লেট-চামচ কোনোরকম ধুয়ে শিশুদের কাছে চটপটি বিক্রি করতে দেখা গেছে। স্কুল ছুটির পর অভিভাবকদেরও সন্তানের বায়না মেটাতে বিভিন্ন ফাস্টফুড জাতীয় খাবার কিনে দিতে দেখা গেছে। ধানমন্ডি এলাকায় বেশ কয়েকটি স্কুল ছুটির পর অভিভাবকদের সেই এলাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের চিকেন ফ্রাই, বার্গার, পিত্জা ইত্যাদি খাবার তাদের সন্তানদের কিনে দিতে দেখা গেছে। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর এলাকার একটি রেস্টুরেন্টের সামনে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের এক শিক্ষার্থীর মা লামিয়া রহমান জানান, স্কুলের টিফিনে ঘরে তৈরি খাবার দিলে সন্তান খেতে চায় না। কিন্তু ফাস্টফুড কিনে দিলে খায়। এমনকি বাসায় ফেরার সময় প্রায় দিনই সন্তানের আবদার মেটাতে চিকেন ফ্রাই কিনে দিতে হয়। পুষ্টিবিদরা জানান, ফাস্টফুডে বিদ্যমান খাদ্য উপাদানগুলো হচ্ছে— উচ্চ মাত্রার শর্করা জাতীয় (স্যাচুরেটেড ফ্যাট), উচ্চমাত্রার ক্যালোরি, চর্বি, সম্পৃক্ত চর্বি, চিনি ও লবণ। খাদ্যের এ উপাদানগুলোতে পুষ্টিগুণ কম থাকে। ফাস্টফুডে বিদ্যমান শ্বেতসারের কারণে শিশুদের পেট ভরার অনুভূতি তৈরি হয় না। ফলে তারা বেশি খেয়ে স্থূল হয়ে যায়। মোটা শিশুরা দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে খলাধুলা বা শারীরিক কাজে কম সময় দেয়। এতে শিশুদের আলসেমিতে পেয়ে বসে। তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে। বাড়ে মানসিক চাপ। এ ছাড়া অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়ার কারণে শিশুরা কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্লান্তি, মনোযোগের অভাব ও রক্তশূন্যতায় ভোগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মাওলা বলেন, ফাস্টফুড সুষম খাদ্য নয়। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের কারণে শিশুরা সহজেই ফাস্টফুডে আকৃষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, ফাস্টফুডে কার্বোহাইড্রেড ও তেলের পরিমাণ বেশি থাকে। এগুলো গ্রহণে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং লিভার সঠিকভাবে কাজ করে না।

সর্বশেষ খবর