মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

নরসিংদীতে হাতে টানা তাঁতের অস্তিত্ব বিপন্ন

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও সঞ্জিত সাহা, নরসিংদী থেকে

নরসিংদীতে হাতে টানা তাঁতের অস্তিত্ব বিপন্ন

বিদ্যুতচালিত তাঁতের (পাওয়ারলুম) দাপটে নরসিংদীতে হাতেটানা তাঁতের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠেছে। নরসিংদী জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁতে উত্পন্ন হয় নানা ধরনের কাপড়। তাঁত চলে দিনরাত। তাই শোনা যায় ‘খটাখট খটাখট’ শব্দ। এই শব্দটা আসে পাওয়ারলুম থেকে। আগে এই শব্দ করত হাতেটানা তাঁত। হাতেটানা তাঁতে এখনো কাপড় বোনা হয়। তবে খুব কম। তাঁতিরা বেশি বেশি করে ঝুঁকছেন বিদ্যুত্চালিত তাঁতের দিকে। প্রশ্ন উঠেছে আর কতদিন টিকবে হাতে টানা তাঁত? স্বাধীনতার পর নরসিংদীর এই তাঁতশিল্প আধুনিকতার ছোঁয়ায় অগ্রসর হতে হতে (টেক্সটাইল, ডাইং ও প্রিন্টিং, নিটিং) পোশাকশিল্পে সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁতের উৎপাদিত পণ্যকে ঘিরে সদর উপজেলার শেকেরচর এলাকায় গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের হাট। ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টার এলাকা বস্ত্র উৎপাদনের জন্য বিশ্বখ্যাত। পাকিস্তানি শাসনামলে নরসিংদীকে বলা হতো ‘প্রাচ্যের ম্যানচেষ্টার।’ এই অঞ্চলে হাতেটানা তাঁতে উৎপাদিত কাপড়ই সুনামটি বয়ে এনেছিল। নরসিংদীতে তাঁত শিল্পের সূচনা কবে থেকে তা সুনিশ্চিত নয়। তবে কেউ কেউ বলছেন, বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই দেড় শত বছরেরও আগে বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হস্তচালিত তাঁতে কাপড় বোনা শুরু করেন। শুরুতে এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়ায় তৈরি শাড়ির মান ভালো না হওয়ায় তারা নতুন জায়গার সন্ধানে বের হয়ে পড়েন। খুঁজতে খুঁজতে চলে এলেন রাজশাহী অঞ্চলে। রাজশাহীর আবহাওয়া বস্ত্র উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত মনে না হওয়ায় বসাকরা দুই দলে ভাগ হয়ে একদল চলে আসেন নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, অন্যদল ঢাকার ধামরাইয়ে। তবে এদের কিছু অংশ রেশমি কাপড় বোনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজশাহীতেই থেকে যান। সরেজমিন দেখা যায়, পলাশের ডাঙ্গা ইউনিয়নের তেঁতুলিয়ায় একদা ৫০-৬০ পরিবারের ঘরে ঘরে ছিল হাতেটানা তাঁত। এখন ওরকম তাঁত নেই বললেই চলে। হাতেটানা তাঁতের জায়গায় বসেছে পাওয়ারলুম। গ্রামে ঢুকতেই কানে বাজতে থাকে যান্ত্রিক তাঁতের আওয়াজ। পুরো গ্রাম ঘুরে একটি বাড়িতে দেখা মেলে মাত্র ৮টি হাতেটানা তাঁতের। বাড়ির মালিক ইমরান বলেন, আশপাশের সবাই এখন পাওয়ারলুম দিয়ে কাপড় বোনেন। পাওয়ারলুমের দাম বেশি তাই আমি এখনো হাতেটানা তাঁত দিয়েই কাপড় তৈরি করছি। পাশের বাড়ির জাহাঙ্গীর বলেন, আমারও ১২টি হাতেটানা তাঁত ছিল। এখন ১টি হাতেটানা তাঁত স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়ে বাকি সব বিক্রি করে দিয়েছি। আমি এখানে এখন পাওয়ারলুম বসিয়েছি। পাওয়ারলুমে সময় বাঁচে। শ্রমিকও কম লাগে। তিনি বলেন, হাতেটানা তাঁতে ১২ ঘণ্টায় বোনা হতো ২০-৩০ গজ কাপড়। আর পাওয়ারলুমে ২০০ গজ। এ সময় পাওয়ারলুমের মেকানিক মোরশেদ বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁত মেশিনও পাল্টে গেছে। তিনি বলেন, হাতেটানা তাঁতের মূল্য ছিল ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু পাওয়ারলুমের মূল্য ১ থেকে ২ লাখ টাকা। পাশের বাড়ির নাজিম জানান, তাঁর বাড়িতে ৫টি হাতেটানা তাঁত। মাঝে-মধ্যে চালান। তবে ঈদের সময় এসব হাতেটানা তাঁত একটিও বসে থাকে না। কারণ ওই সময় কাপড়ের চাহিদা থাকে বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ, আমিরগঞ্জ, চরসুবুদ্ধি, হাইরমারা, নিলক্ষা, নলবাটা, কাট্টাখালি, মনিপুরা, নরসিংদী সদরের সাটিরপাড়া, রাঙ্গামাটি, হাজিপুর, ঘোড়াদিয়া, চরাঞ্চলের করিমপুর, নজরপুর, চম্পক নগর, বাবুরহাট (শেখেরচর), মাধবদী, কৌলানপুর, ভাটপাড়া, ভগীরথপুর এবং পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল, ডাঙ্গা, তেঁতুলিয়া, পাইকারদী, পাইকশা এলাকায় ছিল হস্তচালিত তাঁতের জন্য বিখ্যাত। হস্তচালিত ও বিদ্যুত্চালিত তাঁত মিলিয়ে নরসিংদী জেলায় ৪ লক্ষাধিক তাঁত রয়েছে। এসব তাঁত কলে শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, গামছা, বিছানার চাদর, পর্দার কাপড়, তোয়ালেসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় উৎপাদন করে থাকে। এ অঞ্চলের কাপড়ের গুণগতমান, আধুনিক ডিজাইন ও নৈপুণ্যতার পাশাপাশি সুলভ মূল্য হওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে এখানকার তৈরি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা। এখানকার উৎপাদিত তাঁতের কাপড় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। এখানকার তাঁতিরা জানান, নরসিংদীর তাঁত কারখানাগুলোতে তৈরি ভালো মানের একটি লুঙ্গির দাম ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। শাড়ি ১৮০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা। এই মূল্যহার অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক কম।  ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’ মানে নরসিংদীর বাবুরহাট। ১৯৩৪ সালে স্থানীয় এক জমিদার বাবু কাপড়ের বাজার বসানোর জন্য জমি দান করেছিলেন। ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে আর বাবুরহাটের নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। এই বাজারে নরসিংদীতে উৎপাদিত কাপড়ের বেপারীরা ‘মাল’ নিয়ে তো আসেনই দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাও কাপড় দিয়ে পসরা সাজান। নরসিংদী জেলা পাওয়ারলুম টেক্সটাইল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম ফজলুল হক বলেন, জেলার প্রায় চার লক্ষাধিক তাঁতের সঙ্গে ১০ লক্ষাধিক লোকের পেশা জড়িত। জেলায় টেক্সটাইল, ড্রাইং, ফিনিশিং, সাইজিংসহ সব ধরনের কারখানা রয়েছে। এক কথায় তুলা থেকে সুতা আর সে সুতা থেকে কাপড় তৈরির সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে এই জেলায়। তা ছাড়া নরসিংদীতে উৎপাদিত কাপড় দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের কাপড়ের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।

সর্বশেষ খবর