মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়ে হাত বাড়ালেই মাদক

মাহমুদ আজহার, সরকার হায়দার ও আবদুল লতিফ লিটু

ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়ে হাত বাড়ালেই মাদক

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার ১নং বাংলাবান্ধা ইউনিয়নের নারায়ণজোত গ্রাম। ওই গ্রামে ‘ম’ আদ্যাক্ষরের এক ব্যক্তির বাড়িতে ফেনসিডিলসহ ভারতীয় মদের হাট। সেখানে কিশোর, যুবক থেকে শুরু করে সব শ্রেণির লোকজনেরই যাতায়াত। ব্যবসায় জড়িত তার স্ত্রীও। একাধিক মাদক মামলার খড়গও ঝুলছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকরে জামিন নিয়ে বেরিয়ে ১০ বছর ধরে একই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। প্রভাবশালী সব পক্ষকেই ‘ম্যানেজ’ করে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তেঁতুলিয়ার শালবাহান রোডের কাজিগজ গ্রামের ‘আ’ আদ্যাক্ষরের আরেক পরিচিত নাম। তিনিও নিজের বাড়িতে ইয়াবা ও ফেনডিসিলের ব্যবসা করছেন। অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। উঠতি বয়সের তরুণদের দেখা মেলে তার বাড়িতে। শুধু এই দুই ব্যক্তিই নন, দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে হাত বাড়ালেই এখন মিলছে মরণগ্রাসী ইয়াবা। সেই সঙ্গে নিম্নমানের ফেনসিডিল, গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদক তো আছেই। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদেরও আসক্তি মাদকে। তরুণদের অনেকেই নিচ্ছেন মাদকের ইনজেকশনও। প্রতিবেশী দেশ থেকে আসছে নানা প্রকার মাদক। দুই জেলায় অন্তত অর্ধশত মাদকের রোড রয়েছে। মাদক ব্যবসায় পুরুষের পাশাপাশি জড়িত নারীরাও। অনেকটা বাধ্য হয়ে স্বামীর চাপে এ ব্যবসায় জড়িত হচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক নারী বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে অভিযোগ করেছেন।  গতকাল পঞ্চগড় সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। চলতি মাসেও ৫টি মাদকের মামলা হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, অভিযান চলবে।’ সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের শহরতলির খালপাড়া গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক ভ্রাম্যমাণ ইয়াবা বিক্রির দোকান খুলে বসেছেন। ইয়াবা সেবনকারীদের জন্য ওই সব বাসায় পাকা ঘর বানানো হয়েছে। পিংক কালারের সেই ঘরের ভিতর থেকে জানালা দিয়ে ক্রেতাদের কাছে ইয়াবা বিক্রি করা হচ্ছে। নিজের শিশু সন্তানদেরও ইয়াবা ব্যবসায় লাগানো হচ্ছে। সেখানে ঘরের মেঝেতে বসে ইয়াবা সেবন করছেন অনেকে। লাল রঙের প্রতিটি ইয়াবা ১৫০ টাকা আর বড় সাইজের গোলাপি রঙের ৩৫০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া শহরের খালপাড়া, হঠাৎ বস্তি, নিশ্চিতপুর কলেজপাড়া, ঠাকুরগাঁও রোড, রেল স্টেশন, জাগরণী ক্লাব ও কলোনিতে ইয়াবা বিক্রি এখন ওপেনসিক্রেট। ঠাকুরগাঁও গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, ‘ইতিমধ্যে বেশ কিছু মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য পারিবারিক ও সামাজিক উদ্যোগ নিতে হবে।’ জানা যায়, তেঁতুলিয়ার তিরনইহাটের হাকিমপুর গ্রামের ‘শ’ আদ্যাক্ষরের এক ব্যক্তি ও শালবাহানের ‘হ’ আদ্যাক্ষরের আরেক ব্যক্তি ফেনসিডিল বিক্রি করছে। রনচণ্ডি বাজারে ‘আ’ আদ্যাক্ষকের এক ব্যক্তি ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করছেন। তেঁতুলিয়া সদরে ‘ম’ আদ্যাক্ষরের এক সুইপারের বাড়িতে প্রতিবেশী দেশের নিম্নমানের মদ প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া আজিজ নগর গ্রামের ‘ই’ আদ্যাক্ষর, আর আদ্যাক্ষর, শালবাহান রোডের ‘জ’ আদ্যাক্ষর এবং ভজনপুরে পেট্রলপাম্প সংলগ্ন এক বাড়িতে ‘র’ আদ্যাক্ষরের ব্যক্তিরা ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, ভারতীয় মদসহ নানা মাদকদ্রব্য বিক্রি করছে। এসবের তালিকাও রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের একটি অংশকে ম্যানেজ করেন বিক্রেতারা। এ কারণে তারা দেখেও না দেখার ভান করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়েও নানা ধরনের মাদক আসছে। এ ছাড়া আটোয়ারী সীমান্তবর্তী সব গ্রাম, তেঁতুলিয়া সীমান্তবর্তী সব গ্রাম, ভজনপুর, সদর উপজেলার চাকলা, দশমাইল শহরের রাজনগর, সদর টার্মিনালসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাদকের স্পট রয়েছে। মাদকবিরোধী সংগঠন ‘ড্রাগস ফ্রি বাংলাদেশ’ এর নির্বাহী পরিচালক আতিকুজ্জামান শাকিল জানান, ‘মাদক নির্মূলে পুলিশের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। তবে সামাজিক সচেতনতাও জরুরি। আমরা মাদকবিরোধী পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করছি। কারা এ কাজে যুক্ত তাদের তালিকা পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে।’ জানা যায়, ঠাকুরগাঁওয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে মাদক ব্যবসায়ীরা। অনেকটা প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে মরণনেশা ইয়াবা। বিজিবি, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর অভিযান চালালেও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার। সীমান্তপথে আসা ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচারকারীদের হাত হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে খুবই সহজে। তবে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত উেকাচ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার ভাষ্য মতে, ঠাকুরগাঁওয়ের ৪টি উপজেলা সীমান্তবর্তী হওয়ায় মাদক চোরাচালানের নিরাপদ ‘রুট’। এখান থেকে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মাদক। ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের বিভিন্ন মহল্লা ও বালিয়াডাঙ্গি উপজেলায় বেশি মাদক কেনাবেচা হচ্ছে। গাঁজা ফেনসিডিল আসে ঠাকুরগাঁও সীমান্ত এলাকা থেকে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম হয়ে সড়ক পথে ঠাকুরগাঁওয়ে ইয়াবা আসছে। নিয়ন্ত্রণ করছে ১০/১২ জন খুচরা বিক্রেতা। মাঝেমধ্যে মাদক ব্যবসায়ী অনেককে আটক করা হয়। উদ্ধার হয় কিছু পরিমাণ মাদকদ্রব্য।  ঠাকুরগাঁও সদরের এক ইয়াবা সেবনকারী জানান, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার ইয়াবা বিক্রি হয়। খুচরা ক্রেতাদের পাশাপাশি পাইকারি ক্রেতারাও এখান থেকে ইয়াবা কিনে নেন। বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার বিভিন্ন স্পটে ইয়াবা বিক্রি হয়। ঠাকুরগাঁও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নূর ইসলম বলেন, ‘জনবল সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হলেও যতটুকু সম্ভব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। তবে যানবাহনের অভাবে তাত্ক্ষণিক অভিযান চালাতে পারছি না।’

 

সর্বশেষ খবর