শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

কবে থামবে বীরাঙ্গনাদের কান্না

কেমন আছেন বীরাঙ্গনারা

গোলাম রাব্বানী, শেরপুর থেকে ফিরে

পাক হানাদারদের নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত একাত্তরের আলোচিত গ্রাম সোহাগপুর বিধবাপল্লী। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নে এ পল্লীর অবস্থান। এই গ্রামের ৬২ জন বিধবার মধ্যে অবর্ণনীয় কষ্ট বুকে চেপে রেখে অনেকেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। এখন সেখানে ৩০ জন বিধবার অসহায় বসবাস চলছে। এর মধ্যে ১৪ জন বীরাঙ্গনাও রয়েছেন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের প্রশ্ন— কবে থামবে বীরাঙ্গনাদের কান্না? সোহাগপুরের বিধবা-বীরাঙ্গনা ও শহীদ পরিবারের পাশে সরকার দাঁড়াচ্ছে না কেন? স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও কেন থামছে না বীরাঙ্গনাদের কান্না? বিনা চিকিৎসায় অনেকের জীবনাবসান ঘটেছে। যারা বেঁচে আছেন তারাও অর্ধাহারে-আনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ বা ঝি-বুয়ার কাজ করে দিনাতিপাত করছেন। মাথা গোঁজারও ঠাঁই পাচ্ছেন না অনেকে। সরকার এখনো সব বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে পারেনি। অসুখ-বিসুখে নুয়ে পড়া বিধবা-বীরাঙ্গনারা সরকারের কাছে মাথা গোঁজার ঠাঁই চান, খাবার চান ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান। তবে তারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়াকে আজ মর্যাদার লড়াই হিসেবেই দেখছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারিয়ে দেশ স্বাধীন করলেও জীবনযুদ্ধে পরাজিত বীরাঙ্গনারা। প্রতিনিয়ত বাঁচার জন্য লড়াই করছেন তারা। বিজয়ের ৪৬ বছর পরও সেই দিনের নৃশংসতার কথা মনে করে এখনো কান্নায় বুক ভাসান শহীদের স্বজনরা। সরেজমিন ঘুরে বীরাঙ্গনাদের দিনযাপনের ভয়াল চিত্রের দেখা মিলেছে সোহাগপুরের বিধবাপল্লীতে। এই পল্লীর বিধবারা মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন নিজেদের স্বামী-সন্তান ও পিতাকে। সেই সঙ্গে নিজের সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে অনেককেই। সামাজিক বঞ্চনা ও যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সংসার চালাচ্ছেন তারা। অনাহার-অর্ধাহার তাদের নিত্যসঙ্গী। মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই অনেকের। রাস্তার পাশে কিংবা অন্যের পরিত্যক্ত ঘরেই চলছে তাদের বসবাস। কিন্তু নিছক বিধবা ভাতা, একটি বেসরকারি ব্যাংক ও একটি সংস্থার সহযোগিতা ছাড়া আর কোনো সরকারি সহযোগিতা জোটেনি তাদের ভাগ্যে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দুই বছর ধরে নুরে মান বেওয়ার সারা শরীর অবশ হয়ে আছে। তখন চিকিৎসক দেখালেও টাকার অভাবে আর কোনো ভালো চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। ঘরের মেঝে ও আঙিনায় কাটছে তার জীবন। শেরপুরের বিগত জেলা প্রশাসক তাকে চিকিৎসার জন্য জেলা সদরে ডেকে পাঠালেও তার চিকিৎসা না করিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার স্বজনরা। তার ছেলে চা বিক্রেতা নুরুল হক অর্থের অভাবে মাকে চিকিৎসা করাতে পারেননি। ছেলে বলেন, ‘টেহার অভাবে মারে ভালা কোনো ডাক্তারের কাছে নিবার পাইছি না। ভাতার যে টেহা পাওয়া যায় এই টেহা দিয়া ঠিকমতো খাওয়ুনি চলে না। ডাক্তার দেহামু কেমনে? অহন আমি নিরুপায়’ বলে চুপ হয়ে যান তিনি। যদিও ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না নুরে মান বেওয়া। কিন্তু তার পাশে বসে কথা বলার চেষ্টা করলেও চোখে পানি ছলছল করছিল। এ বিষয়ে বর্তমান জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি, অনেক কিছু জানি না। তবে অসুস্থ নুরে মানের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এই গ্রামের বীরাঙ্গনা করফুলি বেওয়া। স্বামী রহিম উদ্দিন। বিধবা ভাতা ও বেসরকারি ব্যাংকের সহযোগিতায় তার সংসার চলছে। তিনি বলেন, ‘এই টাকা দিয়ে খেতে পারলেও চিকিৎসা করাতে পারি না। এর আগে ঢাকায় চিকিৎসা করানো হয়েছে। কিন্তু নিয়মিত ওষুধ কিনতে অনেক টাকা লাগে। এই যৎসামান্য টাকায় খাওয়া, ওষুধ কেনাসহ সংসার চলে না।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৫ জুলাই সকালে এই গ্রামে অতর্কিত হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। হায়েনার দল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৭৮ নিরীহ পুরুষকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। সম্ভ্রম লুটে নেয় স্বামীহারা নারীদের। সব পুরুষকে হত্যা করায় পুরুষশূন্য হয় পড়ে গ্রাম। তখনই গ্রামের নাম হয় ‘বিধবাপল্লী’। বিধবারা আজও স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে চেপে এই গ্রামে বসবাস করছেন। কিন্তু তাদের জীবনমানের কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। তবে এখন তারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে আছেন। শহীদ পরিবারের সন্তান মো. কফিল উদ্দিন (৫০) বলেন, বেঁচে থাকা বিধবারা বয়সের কারণে সবাই অসুস্থ। এর মধ্যে চারজন শয্যাশায়ী। সরকারি-বেসরকারি মাধ্যম থেকে একজন বিধবা মাসে ২ হাজার ৮০০ টাকা পান। এই দিয়ে বিধবাদের দিন চলে না। এদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। বিধবা ও শহীদ পরিবারের কয়েকজন জানান, বেঁচে থাকা ৩০ জন বিধবা প্রতি মাসে একটি ব্যাংকের ২ হাজার, বেসরকারি একটি সংস্থার ৪০০ ও বিধবা ভাতা হিসেবে ৪০০ টাকা পান; যাতে তাদের জীবন চলে। এতে দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা হলেও ভালো কোনো চিকিৎসক দেখানো অথবা ওযুধ কেনা সম্ভব হয় না। তাই বাধ্য হয়ে রোগ-শোক নিয়ে তাদের অমানবিকভাবে দিন কাটাতে হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর