মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বেনারসি পল্লীর শাড়িকাহন

জিন্নাতুন নূর

বেনারসি পল্লীর শাড়িকাহন

বেনারসি পল্লী। যেখানে আছে ঐতিহ্যবাহী বেনারসি, কাতান, জামদানি ও দেশীয় তাঁতের তৈরি শাড়ির বিশাল সম্ভার। বিয়ের শাড়ি কেনার জন্য এখনো প্রথম পছন্দের স্থান মিরপুর ১০ নম্বরের বেনারসি পল্লী। ক্রেতাদের মতে, সুন্দর বুনন এবং দাম বাজেটের মধ্যে হওয়ায় বেনারসি পল্লীর শাড়ি এখনো অন্যান্য শাড়ির মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর তাই কনের জন্য লাল টুকটুকে শাড়ি ছাড়াও বিয়েতে আত্মীয়দের উপহার দেওয়ার জন্য এবং বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে পরার উপযোগী শাড়ি কেনার জন্যও ক্রেতারা বেনারসি পল্লীকে বেছে নেন। বেনারসি ছাড়া যেন জমে না অনুষ্ঠান : সরেজমিন দেখা যায়, বেনারসি পল্লীর আলোক ঝলমলে এক-একটি দোকানে আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ও ক্রেতাদের বসার জন্য আরাম-কেদারা। দোকানগুলোর কাচের অপর পাশে পুতুলের গায়ে পরানো জরি, চুমকি ও পাথরের কাজ করা চোখ ধাঁধানো সব শাড়ি। অথচ বেশির ভাগ দোকানেই বিক্রেতারা ক্রেতার অপেক্ষায় অলস সময় কাটাচ্ছেন। কয়েকটি দোকানে ক্রেতার দেখা পাওয়া যায়। তাদের আবার বিক্রেতারা কোমল পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করাচ্ছেন। বিক্রেতারা জানান, সাধারণত বিয়ের শাড়ি কেনার জন্যই ক্রেতারা এখানে বেশি আসেন। এ জন্য শীতকালে ও বিয়ের মৌসুমে বেচাবিক্রি বেশি হয়।

আর মাত্র কয়েক দিন পরই বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। বৈশাখকে কেন্দ্র করে জামদানি, দেশি তাঁতের শাড়ি বেশি আনা হয়। কিন্তু নগরীর বিভিন্ন শপিং মল ও বুটিক হাউসগুলোতে বৈশাখের বেচাকেনা যেমন তুঙ্গে থাকে বেনারসি পল্লীতে সে অর্থে জমে ওঠে না। বিক্রেতারা বলেন, প্রচারণা না থাকায় তুলনামূলক কম বিক্রি হয়। অন্যদিকে আজকাল ফেসবুক ও ম্যাগাজিনে মানুষ তার পণ্যের প্রচার করছে। কিন্তু বেনারসি পল্লীর বিক্রেতারা এখনো প্রচারণার দিক দিয়ে পিছিয়ে আছেন। বেনারসি পল্লীর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. কাশেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আশির দশক থেকে এই পল্লী বিস্তার লাভ করে। আগের তুলনায় এখানে কারখানার সংখ্যা কমলেও দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি এশিয়ার সর্ববৃহৎ শাড়ি মার্কেটগুলোর একটি। এখানে কোনো রকম রাজনৈতিক চর্চা ছাড়াই মালিক সমিতি বেনারসি পল্লীর ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো দেখছেন। জানা যায়, পল্লীতে প্রবেশের পথেই নির্মিত হয়েছে তিনটি বিশাল লোহার প্রবেশদ্বার। পল্লীর দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী জেরিন সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক বেলাল আহমেদ জানান, কয়েক বছর ধরে বেনারসি শিল্পের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, ভারতীয় শাড়ির অবাধ বাণিজ্যসহ আরও নানাবিধ কারণে তাঁতিরা এ ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে শুরু করেছেন। তবে সম্প্রতি বেনারসি ও কাতান শাড়ি কেনার চাহিদা ফের বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ শিল্প নিয়ে পুনরায় আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।

দিয়া শাড়ী’জ দোকানের এক বিক্রেতা জানান, বেনারসি পল্লী থেকে শাড়ি নিয়ে ঢাকার বড় শপিং মলগুলোতে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু যারা ভালো বেনারসি বা কাতান শাড়ি কিনতে আগ্রহী তারা মিরপুর বেনারসি পল্লীতে এসেই সাশ্রয়ী মূল্যে শাড়ি কেনেন।

জানা যায়, বেনারসি পল্লীতে দোকানের সংখ্যা একশর ওপরে। দোকানের পাশেই রয়েছে শাড়ি তৈরির নিজস্ব কারখানা। এতে বাঙালিসহ উর্দু ভাষাভাষীরা কাজ করেন। স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে বেনারসি পল্লী এখন বড় বড় শোরুম, বিদেশি ক্রেতা এবং দেশের বাইরেও উন্নতমানের শাড়ি রপ্তানি করছে। বেনারসি পল্লীর বয়স্ক বিক্রেতারা জানান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ভাসানটেকে একটি স্থায়ী বেনারসি মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে সময়  দুই হাজার তাঁতি ও শাড়ি ব্যবসায়ীর থেকে তাঁত বোর্ডের নামে ১০ হাজার টাকা চাঁদা তুলে সোনালী ব্যাংকে জমা করা হয়। কিন্তু তাঁতিরা এখন পর্যন্ত স্থায়ী মার্কেটের দেখা পাননি। এরপরও এ পল্লীর জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে সেগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি। এ জন্য স্বাধীনতার পর থেকে মিরপুর ১০ নম্বরে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী তাঁতিরা বাসার সামনে দোকান বানিয়ে বা ভাড়া নিয়ে বেনারসি পল্লী তৈরি করেন। আর শাড়ি ব্যবসায়ীদের এ উদ্যোগের জন্যই গড়ে উঠেছে ‘মিরপুর ১০ নম্বর বেনারসি পল্লী দোকান মালিক সমিতি’।

বেনারসি পল্লী গড়ে ওঠার ইতিহাস : ৫৫ বছর আগে ভারতের বেনারস থেকে বেনারসি তাঁতসামগ্রী নিয়ে হারুন শেঠ প্রথমে এ দেশে শুরু করেন বেনারসি শাড়ির ব্যবসা। তারই হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় বেনারসি পল্লীর। ধীরে ধীরে সুল্লিদা, বাব্বন শেঠ, কাজিম শেঠ, বেলাল আহমেদসহ অনেক বাঙালি ও অবাঙালি বেনারসি শিল্পের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। দেশ বিভাগের পর এ শিল্পের আরও প্রসার ঘটে। ১৯৮৫ সালের দিকে ঢাকাবাসীর কাছে মিরপুরের বেনারসি শাড়ির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রিয়জনকে শাড়ি উপহার দেওয়ার জন্য বেনারসি পল্লীতে আসতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে বেনারসি, কাতান, ঢাকাই মসলিন, ঢাকাই জামদানি, পিওর সিল্ক, মটকা সিল্ক ইত্যাদি শাড়ির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর