মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

খুঁড়িয়ে চলছে গাজীপুর সিটি

জনগণের টাকা লুটপাট করছে কর্তৃপক্ষ : মেয়র মান্নান • প্রত্যাশার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি : আজমত উল্লাহ খান

শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও খায়রুল ইসলাম

খুঁড়িয়ে চলছে গাজীপুর সিটি

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিটি করপোরেশন গাজীপুর। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচিত মেয়র বসতে পারছেন না চেয়ারে। এখানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে স্থাপনা, বাসা-বাড়ি, শিল্প-কলকারখানা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও জলাবদ্ধতা। নিত্যসঙ্গী যানজট, ধুলা-আবর্জনা। বেশির ভাগ সড়কের বেহাল দশা। অনিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ আরও নানা সমস্যা। যেন দেখার কেউ নেই। নির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান অভিযোগ করলেন, ভারপ্রাপ্তরা জনগণের টাকা লুটপাট করছেন। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান বললেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন যে উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছিল, নাগরিক সুবিধার দিক থেকে সে পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। আর ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. আসাদুর রহমান কিরণ বললেন, ‘নিয়মের বাইরে কি কিছু করা যায় না? এ ধরনের কোনো সুযোগ কি নেই?’ জানা যায়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আয়তন ৩২৯ দশমিক ৫৩ বর্গ কিলোমিটার।

 

এখানে প্রায় ২৫ লাখ লোকের বাস। শিল্প-কারখানায় কাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন জেলা থেকে আরও প্রায় ছয় লাখ মানুষ প্রতিদিন এ জেলায় আসে। শিল্প-কারখানাসমৃদ্ধ গাজীপুর সিটি করপোরেশন আগের গাজীপুর ও টঙ্গী পৌরসভা এবং পুবাইল, বাসন, গাছা, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, কাউলতিয়া ইউনিয়ন নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি। ওই বছরের ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নগরবাসী বহু প্রত্যাশা নিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। কিন্তু মেয়র ও কাউন্সিলররা দায়িত্ব নিলেও জনসেবার জন্য যে গতিশীলতা প্রয়োজন তা একেবারেই দেখা যায় না। প্রয়োজনীয় জনবল নেই, রয়েছে অর্থ সংকট। সরকারের যেসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিটি এলাকায় রয়েছে, এগুলোর মধ্যে কোনোটিই এখনো করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। জানতে চাইলে মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সিটি করপোরেশনে লুটপাট হচ্ছে। এতে নগরবাসীর স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘১০ টাকা আয় হলে আট টাকা বর্তমান কর্তৃপক্ষ রেখে দেয় আর দুই টাকার কাজ করে। তিনি বলেন, সামনে আর এক বছর আছে। আমি দায়িত্ব বুঝে পেলে চেষ্টা করব নগরবাসীর কাছে আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করার।’ তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত সব সময়ই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। বরখাস্ত করে কখনো উন্নয়ন হয় না। মান্নান বলেন, সরকারের একটি পক্ষ তিনি মেয়র পদে বসে কার্যক্রম পরিচালনা করেন তা চায় না। তাই বারবার মামলায় জড়িয়ে তাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হচ্ছে। মেয়র বলেন, দুই দফা তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এখনো তার আশঙ্কা, এবার নগর ভবনের দায়িত্ব পেলে হয়তো আবারও কোনো মামলায় জড়িয়ে তাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হবে। উল্লেখ্য, যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলার মামলায় ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক এম এ মান্নানকে ঢাকার বারিধারার ডিওএইচএসের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০১৫ সালের ১৯ আগস্ট প্রথম দফায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সে আদেশ ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল হাই কোর্ট স্থগিত করে। ১৩ এপ্রিল আপিল বিভাগে হাই কোর্টের আদেশ বহাল থাকে। এরপর দায়িত্বে ফেরার আগেই ওই বছরের ১৫ এপ্রিল অধ্যাপক এম এ মান্নানকে ফের গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৮ এপ্রিল তাকে দ্বিতীয় দফায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি অধ্যাপক মান্নান উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। অধ্যাপক মান্নানের অবর্তমানে ২০১৫ সালের ৮ মার্চ থেকে প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ভোগান্তি : গাজীপুরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে তেমন কিছু চোখে পড়েনি। যেখানে-সেখানে জমে আছে আবর্জনা। ব্যস্ততম এলাকাগুলোতেও আবর্জনার স্তূপ। স্থায়ী ডাম্পিং পয়েন্ট না থাকায় দৈনন্দিন বর্জ্যের ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সড়ক-মহাসড়কের পাশ। যেখানে ফাঁকা জায়গা মিলছে সেখানেই ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। ময়লা ফেলা হচ্ছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সাইনবোর্ড, বাইপাস সড়কের ভোগড়া ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কড্ডা এলাকায়। প্রতিদিন টঙ্গী, জয়দেবপুর, চান্দনা চৌরাস্তার সড়কদ্বীপের চারধারে, কোনাবাড়ী, ছয়দানা হারিকেন ফ্যাক্টরির সামনে ছাড়াও শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে রিকশাভ্যান বা ট্রাকে করে দিনে-রাতে নাগরিকদের গৃহস্থালি বর্জ্য এনে এসব স্থানে ফেলা হচ্ছে।

ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও জলাবদ্ধতা : মহানগরীতে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত স্থাপনা, বাসা-বাড়ি, শিল্প-কলকারখানা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে পরিকল্পিতভাবে ড্রেন নির্মাণ করা হয়নি কোথাও। অনেক এলাকায় কোনো ড্রেনই নেই। কিছু এলাকায় সড়ক-মহাসড়কের ফুটপাথের নিচ দিয়ে ড্রেন থাকলেও বেশির ভাগ এলাকায় রাস্তাই ড্রেন হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।

যানজট : গাজীপুর মহানগরীর জয়দেবপুর লেভেল ক্রসিংয়ের যানজট নগরবাসীর দুঃখ। এ ছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী সেতু থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যানজট জেলাবাসী তথা সমগ্র উত্তরবঙ্গবাসীর দুর্ভোগের কারণ। সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী রেলপথগুলোও এ জেলার ওপর দিয়েই স্থাপিত। অত্যন্ত ব্যস্ততম জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনে দিনে ৫৮টি ট্রেন যাতায়াত করে। ফলে দৈনিক ৫৮ বার এ রেলক্রসিংয়ে সিগন্যাল-বার নামিয়ে রাখতে হয়। এতে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৯ ঘণ্টা নিয়মিত যানজট থাকে। মহানগরীর নাগরিক তথা শহরে আগত সবাকে অলিখিত ও অলঙ্ঘনীয় এ দুর্ভোগ প্রতিদিন মোকাবিলা করতে হয়।

ধুলা, আবর্জনা আর বাড়তি ট্যাক্সের শহর : মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রথম ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’র দুই ধার জুড়ে জমে আছে আবর্জনা। উত্কট গন্ধ চারপাশে। সব এলাকায় স্ট্রিট লাইট না থাকায় রাতের বেলা ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয় পুরো সিটি করপোরেশন এলাকা। রাস্তা ভাঙা, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ, যানজট, অপ্রতুল ট্রাফিক ব্যবস্থা, নাগরিক সুবিধার একটি দিকও নেই। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ট্যাক্স বাড়লেও সেবার মান সেই তুলনায় বাড়েনি।

বেশির ভাগ সড়কের বেহাল দশা : নামে সিটি করপোরেশন হলেও এখন পর্যন্ত এ নগরীর বেশির ভাগ রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। নান্দনিক শহর গড়ে তোলা তো দূরের কথা, সিটি করপোরেশন হিসেবে এখানে অবকাঠামোগত খাতে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়াই লাগেনি। বেশির ভাগ সড়কের বেহাল দশা। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শিল্পসমৃদ্ধ টঙ্গী, গাছা, বোর্ডবাজার, জেলা সদর, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর এলাকার সড়কগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে, এসব সড়কে কোনো যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের হেঁটে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। অন্যদিকে মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্রও খুবই করুণ। যত্রতত্র খানাখন্দে ভরা। একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় জনদুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন যে উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছিল, নাগরিক সুবিধার দিক থেকে সে পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। সিটি করপোরেশন বা যে কোনো লোকাল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউশনের বেসিক আয় হলো তাদের নিজস্ব আয়, যেটা ট্যাক্স, ফি, রেট থেকে আসবে। সিটি করপোরেশন যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে হোল্ডিং ট্যাক্স তেমন হবে না। কারণ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বেশ কিছু রুরাল এরিয়া রয়েছে। অনেক এলাকার মানুষ ট্যাক্স দিতে অভ্যস্ত নয়। টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভার মানুষ হোল্ডিং ট্যাক্স দেওয়ায় অভ্যস্ত ছিল। বাকি ছয়টি এলাকার মানুষ হোল্ডিং ট্যাক্স দিয়ে তারা অভ্যস্ত নয়। তাই তাদের ট্যাক্সমুখী করতে হলে সেবাকে প্রথমে তাদের মধ্যে পৌঁছাতে হবে। তারা ট্যাক্স দেবেন এ ব্যাপারে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে নাগরিকদের নিয়ে নাগরিক কমিটি গঠন করতে হবে। ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. আসাদুর রহমান কিরণ বলেন, দায়িত্ব নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মন্ত্রী, এমপি ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের যেভাবে উন্নয়ন করেছি, তা দৃশ্যমান। এটা লুকানোর কিছু নেই। নিয়মের বাইরে কি কিছু করা যায় না? এ ধরনের কোনো সুযোগ কি নেই? প্রতিটি ওয়ার্ডের প্রতিটি রাস্তা উন্নয়নের পর্যায়ে আনার জন্য আমরা চেষ্টা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘যে আশা নিয়ে ও প্রত্যাশা করে সিটি করপোরেশন করা হয়েছিল, কিছুটা সেবা আমরা দিতে পেরেছি। একাধিক প্রকল্প চলমান আছে, কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এগুলো বাস্তবায়িত হলে ইনশা আল্লাহ অনেক সমস্যার সমাধান হবে।’

 

সর্বশেষ খবর