বারে বারে ডোবে কেন চট্টগ্রাম? বৃষ্টি কিংবা কর্ণফুলীর জোয়ারে যে জনদুর্ভোগ, তা কি তবে আর ঘুচবে না? এমন নানা প্রশ্নে গেল কদিনের বৃষ্টিপাতে চট্টগ্রামে উদ্বিগ্ন নাগরিকরা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) অথবা চট্টগ্রাম ওয়াসার টেবিল থেকে টেবিলে কিংবা চায়ের আড্ডায়, মাঠে-ময়দানে ঘুরেফিরে আলোচ্য বিষয় শুধু যেন একটাই— জলাবদ্ধতা। এ নিয়ে কেউ কারও মুণ্ডু চটকান, কেউ হতাশার মধ্যেও আশার আলো খোঁজেন। তবে বারে বারে চট্টগ্রাম নগরীর এভাবে জলবন্দী অবস্থার পেছনে নানা কারণ উঠে এসেছে বিশেষজ্ঞসহ নগরবাসীর ভাষ্যে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, অন্তত ২০ বছর চট্টগ্রামের উন্নয়নে চউকের প্রণীত মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন না করাই এর প্রধানতম কারণ। খোদ চসিকই মাস্টারপ্ল্যানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। প্ল্যানটির সুপারিশ বা প্রস্তাবনাকে উপেক্ষা করে নালার ওপর স্থাপনা গড়েছে সংস্থাটি। ফলে আইন অমান্যের সুযোগ নিয়েছেন কতিপয় প্রভাবশালী নাগরিক। তারাও খাল-নালা-ডোবা দখল করে ভবন-দোকান-অফিস গড়ে পানি নিষ্কাশনের রাস্তা বন্ধ করেছেন। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জলবন্দী হচ্ছে চট্টগ্রাম শহর। এই জলবন্দী অবস্থার জন্য প্রধানত অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই দুষছেন শহরবাসী। তবে এতটা বছরেও এই দশা থেকে মুক্তি না মেলার পেছনে কারণ, জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। রয়েছে নগরবাসীর পাশাপাশি কোনো কোনো ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং চসিকের প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্বশীল অনেকের দায়িত্বহীন আচরণ আর ঢিমেতালে ভাব। যেহেতু চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতায় রয়েছে জোয়ারের প্রভাব, তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে লাগোয়া বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীর পানির উচ্চতা বাড়ায় নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধার মুখে পড়েছে, যা জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া খাল ও নালাগুলো ব্যাপক হারে দখল হয়েছে। ফলে অন্যান্য বছরের মতো এবারও বর্ষা আসতে না আসতেই শুক্রবার মাত্র তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত ডুবেছে চট্টগ্রাম। সেদিন ৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। অথচ টানা বৃষ্টির পর মাত্র ১০ মিলিমিটার পানি ধারণের ক্ষমতা রয়েছে বিদ্যমান খাল ও নালাগুলোর। এসবের পাশাপাশি উন্নয়নে অগ্রাধিকার নিশ্চিতে ব্যর্থতা আর বরাদ্দে অপ্রতুলতাও জলাবদ্ধতার কারণ বলে মনে করছেন নগর বিশ্লেষকরা। চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, চট্টগ্রামে বারে বারে এই জলাবদ্ধতার কারণ বের করা ‘হাই ইঞ্জিনিয়ারিং’ ব্যাপার নয়। সাধারণভাবেই এর কারণ বোঝা যায়। নগরীর খাল ভরাট, অপরিকল্পিত নির্মাণ এর প্রধানতম কারণ। পানি নিষ্কাশনের স্থায়ী পদক্ষেপ নেই। প্রকৌশলী ফজলুল্লাহ বলেন, জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রামের কারণ ঢাকার মতো নয়। এতে নদীর জোয়ার-ভাটার প্রভাবও রয়েছে। আর এই প্রভাব নিয়ন্ত্রণে স্লইস গেট নির্মাণসহ নানাভাবে ‘ওয়ান বাই ওয়ান’ পরিকল্পনা না নিলে স্থায়ী সমাধান অসম্ভব। এভাবে উদ্যোগ না নিয়ে অহেতুক আহাজারি করে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব নয়। বারে বারে কেন ডোবে চট্টগ্রাম? এমন প্রশ্নে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম অবশ্য বলেন, শহর না ডোবার যা পন্থা, এর যাবতীয় গাইডলাইন মাস্টারপ্ল্যানেই দেওয়া হয়েছে। তা ফলোআপ না করার কারণে বা কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ধীরে ধীরে এমন ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের কোনো নির্দেশনাই এতটা বছর বাস্তবায়ন করেনি চসিক— এমনটা জানিয়ে মেয়র আ জ ম নাছির বলেন, চট্টগ্রাম শহরে পরিকল্পিত কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা নেই। ড্রেন নির্মাণের ক্ষেত্রে সাজুয্য নেই। খোদ মাস্টারপ্ল্যান যারা বাস্তবায়ন করবে, তাদের মধ্যে চসিকই ড্রেনের ওপর স্থাপনা নির্মাণ করে। চসিককে অনুসরণ করে নগরবাসীও নালার ওপর স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। এদিকে এরই মধ্যে জনসংখ্যা বেড়ে ৬০ লাখ হয়েছে নগরে। বেড়েছে বর্জ্য। অন্যদিকে জলাশয়-জলাধার ভরাট হয়েছে পলিথিন আর ময়লা-আবর্জনায়।এ ছাড়া পাহাড়ের বালি ছড়িয়ে খাল, নালা ভরাট তো হচ্ছেই। এদিকে মাস্টারপ্ল্যানে তিনটি নতুন খাল খননের প্রস্তাব থাকলেও তা করা হয়নি বলে জানান মেয়র আ জ ম নাছির।