শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

নারায়ণগঞ্জে নদী দখলের প্রতিযোগিতা

শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও রোমান চৌধুরী সুমন নারায়ণগঞ্জ থেকে

নারায়ণগঞ্জে নদী দখলের প্রতিযোগিতা

নারায়ণগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদী। দখল হয়ে যাচ্ছে মাঝ নদীও —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাণিজ্যনগরী নারায়ণগঞ্জকে প্রায় ঘিরে রেখেছে ৪টি নদী, ১টি নদ। শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা, ধলেশ্বরী নদী ও ব্রক্ষপুত্র নদ। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এসব নদীর পাড় দখল করে রেখেছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। দখলের এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই ব্যক্তি উদ্যোগও। এসব দখলদারের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো চালিয়েছে অভিযান। কিন্তু রাতের আঁধারে আবারও দখল হয়ে যায় নদীর পাড়গুলো। নদীর পাড় বাঁচাতে প্রত্যেকটি নদীতে সরকারের পক্ষ থেকে স্থাপন করা হয়েছে সীমানা পিলার। কিন্তু নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিভিন্ন সময় দখলদাররা মেতে উঠে নদী দখলের প্রতিযোগিতায়। ‘নদী বাঁচাও’ স্লোগান থাকলেও নারায়ণগঞ্জের নদীগুলো দিন দিন ঠেলে দেওয়া হচ্ছে প্রায় মৃত্যুর মুখে। জেলার বিভিন্ন নদী এলাকা ঘুরে দেখা যায় মূল নদী থেকে শুরু করে শাখা নদীও রক্ষা পায়নি দখলদারদের হাত থেকে। 

সীমানা পিলার নিয়ে নানা অনিয়ম : নারায়ণগঞ্জ মূল শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে গড়ে ওঠা অন্তত ৭০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সামনে সীমানা  কৃত্রিমভাবে নদী ভরাট ও দখলের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অন্তত ২০টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনের সীমানা পিলার নিয়েও রয়েছে আপত্তি। শীতলক্ষ্যা নদীতে ৫ সহস াধিক সীমানা নির্ধারণী পিলার স্থাপন করা হলেও এর মধ্যে দুই সহস্রাধিক পিলার নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। পিলারগুলো পুনঃস্থাপনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী ৪ বছর আগে নির্দেশ দিলেও আজও কিছু করা হয়নি। সূত্রমতে, ২০০৯ সালের জুন মাসে হাই কোর্ট নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীসহ রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী ৪টি নদী রক্ষায় জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএকে নির্দেশ দেয়। জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথ উদ্যোগে সিএস ও আরএস অনুযায়ী জরিপ করে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে। ২০১১ সালে শুরু হয় সীমানা নির্ধারণী পিলার স্থাপনের কাজ। পিলার স্থাপনের কাজটি করে গণপূর্ত বিভাগ। সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। সাধারণত বর্ষাকালে নদীর পানি যে পর্যন্ত ওঠে সেটাকেই নদীর সীমানা বা ফোরশোর বলা হয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী ও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশে সঠিক স্থানে পিলার স্থাপন করা হয়নি। অনেক জায়গায় নদীর ভিতরেই পিলার স্থাপন করা হয়েছে। প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার পার্শ্ববর্তী বুড়িগঙ্গা, বালু ও তুরাগ নদের সীমানা পিলার নদীর ফোরশোর অনুযায়ী স্থাপন করা হলেও শীতলক্ষ্যার ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। প্রতিটি সীমানা পিলার ২০ ফুট থেকে ৭০০ ফুট পর্যন্ত ভিতরে পুনঃস্থাপন করতে হবে।

যে নির্দেশ ৪ বছরেও পালিত হয়নি : জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৬ মে তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্স নদীর সীমানা পিলার স্থাপন কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে নদীর তীর ও ফোরশোরের জায়গা এবং নদীসমূহের বর্ষাকালীন স্বাভাবিক প্রবাহ বিবেচনায় এনে সীমানা নির্ধারণপূর্বক হাই কোর্টের রায় বাস্তবায়নে পিলার পুনঃস্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালকের সহায়তায় নিজ নিজ জেলা প্রশাসনের ওপর এর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এজন্য আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মধ্যে নদীর ফোরশোর নির্ধারণ করে অক্টোবর মাসের মধ্যে পিলার পুনঃস্থাপনের নির্দেশ দেয় টাস্কফোর্স। ৪ বছর অতিবাহিত হলেও সেই নির্দেশ কার্যকর হয়নি। কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জের জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভায় বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন জানান, বিআইডব্লিউটিএ, গণপূর্ত ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে শীতলক্ষ্যা নদীতে স্থাপনকৃত ৫০১১টি সীমানা পিলারের মধ্যে ২১৫৮টি সীমানা পিলারের বিষয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। এসব পিলার যথাস্থানে স্থাপন করা হয়নি। যার মধ্যে শীতলক্ষ্যার পূর্বতীরের ১ হাজার ৩৫৬টি পিলার রয়েছে। ওই সভায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম বলেছেন, আপত্তিকৃত সীমানা পিলারের ভুলগুলো যাচাই-বাছাই করতে হবে। কোনো পিলার ভুল জায়গায় স্থাপন করা হলে সেগুলো দ্রুত পুনরায় সঠিকস্থানে স্থাপন করার মধ্য দিয়ে নদী রক্ষা করতে হবে।

বুড়িগঙ্গা দখল : ফতুল্লায় বুড়িগঙ্গা পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। নদীর পাড়ে রয়েছে অনেক বালু ঘাট। সেখান থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু জেলার বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়। বর্ষা  মৌসুমে বালুর চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ, আর এই অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করতেই নদীর জায়গা দখল করে করা হয় বালু মজুদ। ওই বালুতে ধীরে ধীরে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ বালু মজুদ করতে গিয়ে নদীর অভ্যন্তরে প্রায় ৪০ ফুট দখল করে নিয়েছে বালু ঠিকাদাররা। বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের অফিসঘর নির্মাণ করেছে নদী সীমার ভিতর। নদী সীমানা দখল মুক্ত রাখতে আলীগঞ্জ কোয়ার্টার থেকে ফতুল্লা পোস্ট অফিস পর্যন্ত প্রায় ১.১ কিমি ‘ওয়াকওয়ে’ নির্মাণ করা হয়। ফলে এখানে কেউ সীমানার ভিতর কোনো ব্যক্তিগত স্থাপনা করতে পারেনি। কিন্তু ওয়াকওয়ের পর হতে লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকায় সংকুচিত হচ্ছে নদীটি।

ধলেশ্বরী : ফতুল্লার কাশিপুরে হাটখোলা-গোগনগর ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীর সংযোগ শাখা নদীর ৯ হাজার বর্গফুট বাঁশের পাইলিং (আড়গাড়া) দিয়ে দখল এবং ভরাট করে নতুন ভবন নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। দখল করা স্থানে পাইলিংয়ের মাধ্যমে ভবন নির্মাণের কাজ চালানো হয়। জানা গেছে, সম্প্রতি কয়েক বছর আগে ওই প্রতিষ্ঠান বরাবর একাধিক নোটিস প্রেরণ করেন বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক আরিফ উদ্দিন। ওই নোটিসে উল্লেখ করা হয়, নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর সংযোগ শাখা নদীর উত্তরপাড়ে নদীর গতিধারার ওপর বাঁশের পাইলিং দিয়ে ৯ হাজার বর্গফুট জায়গা দখল ও ভরাট করেছে ওই প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে আরিফ উদ্দিন জানান, ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে একাধিকবার নোটিস দেওয়া হলেও তারা অবৈধ দখল সরিয়ে নেয়নি, বরং আমাকে বিভিন্ন সময়ে হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।

ব্রহ্মপুত্র : বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে অবস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান ব্রহ্মপুত্র নদ। দখলদারদের কবলে পড়ে এই নদ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। কলাগাছিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ দখল করে ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভূমি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পারস্পরিক যোগসাজশে শক্তিমান ব্যক্তিরা নদের ওপরই নির্মাণ করছে পাকা স্থাপনা। এলাকাবাসীর অভিযোগ— এই অনাচার দেখেও যেন না দেখার ভান করছে বন্দর উপজেলা প্রশাসন। দখলদাররা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীনদের কাছের লোকজন হওয়ায় ভয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারছে না স্থানীয়রা। এর আগে গত বছর গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করলেও কোনো প্রতিকার হয়নি। তাই ওই পরিদর্শনকে ‘লোক দেখানো’ বলেও মন্তব্য করছেন অনেকে।

সোনারগাঁয়ে মেঘনা নদী দখল : সোনারগাঁয়ে মেঘনা নদী ও মেঘনা ঘাট এলাকায় দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ইতিমধ্যে মেঘনার প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে তারা। মেঘনা সেতু থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে প্রায় আড়াই বিঘা খাস জমি দখল করে উঠেছে শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া মেঘনা সেতু-সংলগ্ন নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে স্থাপনা ও ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় মেঘনা সেতুর দুই পাশের নিচের জায়গাগুলোতেও অবৈধ দখলে চলছে বালু ও পাথরের ব্যবসা। এদিকে খাস জায়গা ও নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সরকারি উদ্যোগ অব্যাহত থাকলেও তা কাজে আসছে না। সকালে উচ্ছেদ হলে বিকালে হয় পুনর্বাসন। মেঘনাঘাট এলাকায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার সরকারি জমি দখল করে নিয়েছেন এক শিল্পপতি। এতে স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। ওই শিল্পপতি চর রমজান সোনাউল্লাহ্ মৌজার ৩৪২ শতাংশ সরকারি জমি এবং মেঘনা নদীর তীরবর্তী অনেক জমি দখল করে সেখানে কারখানা স্থাপনের পাঁয়তারা করছেন। পাশাপাশি আরও ৩৩০ শতাংশ জমি বালু ভরাটের মাধ্যমে অবৈধভাবে দখল করে পাথর ও বালুর ব্যবসার সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন তিনি। নদী দখল প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক আরিফ উদ্দিন বলেন, আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাই বলেই এখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের নদীগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। যে যেখানেই দখল করুক। আমরা আইনি নোটিস পরবর্তী কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর