শনিবার, ২০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

রমজানে ভেজাল নিয়ে যত শঙ্কা

উচ্চ আদালতের নির্দেশে বন্ধ অভিযান • সুযোগের সদ্ব্যবহারে ব্যস্ত অসাধুরা

জিন্নাতুন নূর

আর মাত্র কয়েক দিন বাদেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। এরই মধ্যে মুসল্লিরা খাদ্যদ্রব্য মজুদ করতে শুরু করেছেন। ব্যস্ততা বেড়েছে খাদ্য ব্যবসায়ীদেরও। এ ছাড়া বাজারে মৌসুমি ফলের বেচাকেনাও শুরু হয়েছে। ক্রেতারা অভিযোগ করছেন, রমজান উপলক্ষে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। আবার মৌসুমি ফলের মধ্যে অকালপক্ব বা রাসায়নিক মিশ্রিত আমের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এবার রমজানে অন্য বছরের মতো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ উচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করায় এখন ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভেজালবিরোধী অভিযান বন্ধ আছে। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্যের ভেজাল রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিকল্প নেই। উন্নত দেশগুলোতে খাদ্যের ভেজাল রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। তাদের মতে, জনস্বার্থে রমজানের আগেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ভেজালবিরোধী অভিযান পুনরায় শুরু করা উচিত।

মধুমাস হওয়ায় বাজারে এখন আম, লিচু, কাঁঠাল ও তরমুজসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল আসছে। এর মধ্যে ফলপ্রেমীদের প্রিয় ফল আম সময়ের আগেই বাজারে এসেছে। এতে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা, এসব আমে ফরমালিন মেশানো হয়েছে। কারণ সময়ের হিসাবে এ মাসের শেষ নাগাদ বাজারে পরিপক্ব আম আসার কথা। দেশের সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদনকারী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আম পাড়ার তারিখ ২৫ মে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর আগেই যেসব আম বাজারে আসছে—সেগুলো কৃত্রিমভাবে ও রাসায়নিক প্রয়োগ করে পাকানো হচ্ছে। এ ছাড়া রমজানের বিভিন্ন আইটেমের মধ্যে এরই মধ্যে বাজারে ভেজাল ছোলা ছাড়া হচ্ছে। জানা গেছে, পুরনো ও ছত্রাক পড়ে যাওয়া ছোলা পুনরায় মিলে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে কিছু ব্যবসায়ী তা নতুন বলে বেশি দামে বিক্রি করছেন। মোবাইল কোর্ট বন্ধ থাকায় আমসহ মৌসুমি ফলে ফরমালিন ও কার্বাইড মেশানোর অভিযোগের কথা স্বীকার করেছেন দেশের বিভিন্ন জেলার ম্যাজিস্ট্র্রেটরা। জেলা প্রশাসকরা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিসহ ভেজাল মেশানোর হার বৃদ্ধি পাবে। সম্প্রতি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট। এতে ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের আওতায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যাবে না। জানা গেছে, এই ঘোষণার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেটদের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এখন বন্ধ আছে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত হাই কোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত করে বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, রাজধানীসহ দেশব্যাপী ইফতারি আইটেমের ভেজাল প্রতিরোধে গত কয়েক বছর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করায় ভেজালের পরিমাণ অনেকটা কমে গিয়েছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষ উভয়েই এ ব্যাপারে একমত। কিন্তু হঠাৎ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক (আইন) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাবেক ম্যাট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেশ কয়েক বছর ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। আগের থেকে অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছে। জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা আবারও খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক দিতে শুরু করবেন। দীর্ঘদিন বিচার কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আমি বলতে চাই, রোজায় ভেজাল প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের প্রয়োজন আছে। এর মাধ্যমে অপরাধীদের দ্রুত বিচার করা যায়। এতে অপরাধপ্রবণতাও কমে আসে। কয়েকজন ম্যাজিস্ট্র্রেট বলেন, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অপরাধের মাত্রা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অপরাধীদের তাত্ক্ষণিক শাস্তি দেওয়া হয়। এজন্য সেসব দেশে অপরাধের মাত্রাও কম।  র‍্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট সরোয়ার আলম বলেন, আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারব কিনা—তা রবিবার জানতে পারব। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট সহযোগে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা খুবই প্রয়োজন। যদি উচ্চ আদালত জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট সহযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার অনুমতি দেয়, তবে দেশবাসীর উপকার হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার বলেন, রোজায় আমরা বড় বাজারগুলোতে দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মনিটর করব। প্রতি সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ দিন ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করব। তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর আস্থা তৈরি হয়েছে। তাত্ক্ষণিকভাবে অপরাধীদের শাস্তি দিতে এর বিকল্প নেই। 

ভেজাল রোধে প্রশাসনের প্রস্তুতি : আসছে রমজানে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য মে মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চকবাজার ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাওরানবাজার এলাকায় জনসচেতনতামূলক সভা করা হবে। ঢাকার কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী ও ক্রেতা সাধারণের বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সচেতনতা কার্যক্রমও পরিচালিত হবে। চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিষ্কারভাবে গড়ে তুলতে ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর বাইরে কোনো ব্যবসায়ী যাতে ফরমালিনযুক্ত ফল বিক্রি করতে না পারে সে জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ প্রস্তুতি নিয়েছে। অভিযান পরিচালনার জন্য পুলিশের যে জনবল লাগবে তার চাহিদাপত্রও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে। এদিকে বাজারে মৌসুমি ফল আসার সঙ্গে সঙ্গে র‍্যাবের মনিটরিং শুরু হয়েছে। শিগগিরই অভিযানও শুরু হবে। বর্তমানে অভিযানের প্রস্ততি চূড়ান্ত পর্যায়ে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট মশিউর রহমান জানান, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম যাতে কিছুতেই না বাড়ে সেজন্য ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর