শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

আবার সক্রিয় ভেজাল চক্র

টার্গেট রমজান, রাজধানীতেই নকল কারখানা ও ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি

সাঈদুর রহমান রিমন

রমজান মাস ও ঈদকে টার্গেট করে রাজধানীজুড়ে নকল কারখানা এবং ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি শুরু হয়েছে। কোনোরকম অনুমোদন ছাড়াই যত্রতত্র কারখানা বসিয়ে ভেজাল খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন চলছে। সেসব মানহীন, স্বাস্থ্যহানিকর খাদ্যপণ্যের বাজারজাতও চলছে প্রকাশ্যে, ঢাকঢোল পিটিয়ে। ইফতারির খাদ্যপণ্যও ভেজালের বিষমুক্ত থাকছে না। নকল কারখানায় উৎপাদিত প্রসাধনী সামগ্রীগুলো আকর্ষণীয় মোড়কে প্যাকেটজাত করে রাজধানীসহ সারা দেশে বাজারজাতও হচ্ছে। প্রতি বছর রমজান শুরুর অন্তত দুই সপ্তাহ আগে থেকেই বিএসটিআই, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো ভেজালবিরোধী অভিযান চালায়। কিন্তু এবার অজ্ঞাত কারণে সংস্থাগুলো নীরব-নির্বিকার। সংশ্লিষ্টদের ঢিলেঢালা ব্যবস্থাপনার সুযোগেই নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদনকারীরা তত্পর হয়ে উঠেছে। শুধু রমজানকে সামনে রেখে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে নকল, মানহীন-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাংলা সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, নুডলস, ঘি, হলুদ, মরিচ, মসলা, বেসন, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, পাউরুটি, কেক ইত্যাদি। এসব ভেজাল পণ্যে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নানা উপকরণ ও রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে যথেচ্ছা। মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামাল, ফরমালিন-কার্বাইড, সুতা রাঙানোর বিষাক্ত রং, ভেজাল পামতেল, সেন্ট, পচা ডিম ইত্যাদি মেশানো হচ্ছে এসব খাদ্যপণ্যে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে অনেকটা কৌশলে বাইরে তালা ঝুলিয়ে আলো-আঁধারি পরিবেশে উৎপাদন করা হয় সেমাই, নুডলস, ঘিসহ অন্যান্য পণ্য। শ্রমিকদের ঘাম অবাধে মিশে যাচ্ছে সেমাইয়ের খামিতে। ছোট ছোট বাঁশের কঞ্চিতে কাঁচা সেমাই সাজিয়ে শুকানো হচ্ছে বদ্ধঘরে মাচা বানিয়ে। এসব সেমাই লাল করা হচ্ছে বিস্কুট তৈরির চুল্লিতে। পরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেবেল সেঁটে টুকরি ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে।

খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোটা রীতিমতো অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফল গাছে থাকা পর্যায় থেকে বাজারে বিক্রির মুহূর্ত পর্যন্ত একেকটি ফলে ছয় দফা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মূলত গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করার কারণেই ফলগুলো রীতিমতো বিষে পরিণত হয়। অন্যদিকে ফলমূল দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করতে ফরমালিনসহ আরও কিছু বিষাক্ত পদার্থেরও ব্যবহার চলে অহরহ। এভাবেই নানা কৃত্রিমতায় খাদ্যদ্রব্য যেমন ভেজাল ও বিষে পরিণত করা হচ্ছে, তেমনি সেসব হয়ে পড়ছে স্বাদহীন-গন্ধহীন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরমালিন উচ্চমাত্রার বিষাক্ত পদার্থ, এর কারণে দ্রুত কিডনি নষ্ট, ক্যান্সার, লিভার ব্যাধি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুদের হার্টের রোগ ও দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। গর্ভজাত মায়ের শিশুও বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। বিএসটিআইর তথ্যে জানা যায়, দেশে সরকারি অনুমোদন রয়েছে এমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রসাধনী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। এযাবৎ ৯৭টি প্রতিষ্ঠানকে সিএম লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে শুধু রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতেই গড়ে উঠেছে আট শতাধিক প্রসাধনী কারখানা। পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, বড়কাটরা, সদরঘাট, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, রহমতগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, ইসলামবাগ, বংশাল, শ্যামপুর, কদমতলী, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, সূত্রাপুর, পোস্তগোলা, ধোলাইখাল, ফরিদাবাদ, ইসলামপুর, সোয়ারীঘাট, দেবীদাস লেন, কামালবাগ, শহীদনগরে নকল কারখানার ছড়াছড়ি রয়েছে। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জের জিনজিরার লছমানগঞ্জ, বুড়িশুর, মান্দাইল, কালিন্দিতে আছে শতাধিক নকল কসমেটিকস কারখানা। টঙ্গীসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের পাগলার বেশ কয়েকটি জায়গায় নকল প্রসাধন তৈরির গুদাম ও কারখানা রয়েছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা প্রসাধন প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই নকল বাণিজ্য চালাচ্ছে। বাজারে প্রচলিত প্রসাধনীর বোতল বা কৌটা, লেবেল ও ট্রেডমার্ক নকল করে হুবহু নকল তৈরি করছে এসব চক্র। এদিকে বিএসটিআইর পক্ষ থেকেও টোকেন বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অবৈধ কারখানার উৎপাদন ও বাজারজাত নির্বিঘ্ন রাখাসহ মোবাইল কোর্টের অভিযানমুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতিতে চলছে এ চাঁদাবাজি। মাঠপর্যায়ে টোকেন বাণিজ্য চুপিসারে পরিচালিত হলেও বিএসটিআই দফতরে তা ওপেন সিক্রেট। টোকেনের মাসোয়ারা বাণিজ্যটি বিএসটিআইর কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কাছে আকর্ষণীয় ‘প্যাকেজ’ হিসেবেই পরিচিত। অনুমোদনহীন নকল কারখানা থেকে প্রতি মাসে সোর্সদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা মাসোয়ারা আদায় হয়ে থাকে। মাসোয়ারা আদায়ের জন্য রাজধানীজুড়ে শতাধিক সোর্স সমন্বয়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছেন। সোর্সরা বিভিন্ন মহল্লা অলিগলি ঘুরে নকল অবৈধ কারখানার তালিকা সংগ্রহের পর সেসব কারখানা মালিকদের ডাক পড়ে বিএসটিআই দফতরে। সেখানে কথাবার্তা চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর মাসোয়ারার টাকা লেনদেন হয় রামপুরার একটি বাসায়। তথ্যমতে, রাজধানীতে শুধু ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট বেকারি কারখানা আছে তিন হাজারেরও বেশি। এগুলোর কোনোটারই অনুমোদন নেই। পানি বোতলজাত ও সরবরাহের কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে পাঁচ শতাধিক মিনি কারখানা। আছে অবৈধ বৈদ্যুতিক তার তৈরি, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, বৈদ্যুতিক পাখা উৎপাদনের নকল কারখানার সংখ্যাও কয়েকশ। অন্যদিকে নকল পারফিউমসহ সব ধরনের প্রসাধনী তৈরির জন্য পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, সূত্রাপুরের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে সহস াধিক অবৈধ কারখানা। এসব কারখানার মালিকরা কেউ মাসোয়ারার হাত থেকে রেহাই পান না।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর