বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘বিক্রয়ের জন্য নহে’ তবুও মিটফোর্ডে হয় বিক্রি

মাঝে মাঝেই চলে অভিযান আবারও পুরনো চেহারায় ফেরে সবাই

মাহবুব মমতাজী

সরকারি হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করা ওষুধ বাইরে বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রতিটি ওষুধের মোড়কে লেখা থাকে ‘বিক্রয়ের জন্য নহে’। তবুও হরহামেশা এসব ওষুধ বিক্রি হচ্ছে মিটফোর্ড এলাকায়। ঢাকা ও তার আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এসব ওষুধ এখানকার মার্কেটগুলোতে এনে বিক্রি করা হয়।

গত এক বছরে মিটফোর্ড এলাকায় বিক্রয় নিষিদ্ধ ওষুধ জব্দে ২৩৪টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে র‌্যাব। এ সময় মোট ৫ কোটি ৫৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ১৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম। 

অভিযোগ রয়েছে, মিটফোর্ডের হাজিরানী মার্কেটে বিক্রি হয় সরকারি হাসপাতাল থেকে পাচার করে আনা বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। তার পাশের দিদার মার্কেটেও মজুদ রেখে বিক্রি করা হয় বিক্রয় নিষিদ্ধ সরকারি ওষুধ। এর আগে হাজিরানী মার্কেটের চারটি গোডাউনে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিষয়টি টের পেয়ে পালিয়ে যান গোডাউন মালিকরা। পরে গোডাউনের তালা ভেঙে ভিতরে বিক্রয় নিষিদ্ধ বিপুল পরিমাণ ওষুধের মজুদ পাওয়া যায়। যেগুলোর প্যাকেটে লেখা ‘সরকারি হাসপাতালের জন্য বিক্রয়ের জন্য নহে।’ ওই গোডাউনে পাইরেক্সিন-১৫২, প্যারাসিটামল, রিসেট, এলবেনডাজল-এলজেড, সিডোপাস-৫০, লিপিকন-২০মি. গ্রা., সেফ্রাডিন ক্যাপসুল, রেনিটিডিন, লুমনা-৫,  ল্যাকলোজ সিরাপ, কিলমা এক্স, ন্যাপ্রোক্স, এমোক্সাসিলিন, ফিনিক্স-২০, ক্যালসিয়াম ল্যাকটেট, সালবিউটামল, পেইনো, মেট্রোনিডাজল, জেনটিন, ইছোরাল, লিপিকন। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্র জানায়, সরকারি হাসপাতালের আউটডোর রোগীদের জন্য ১১১ ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে ট্যাবলেট ৬২টি, সিরাপ ১৫টি, ক্যাপসুল ১৩টি, ২২টি আছে ক্রিম, ইনজেকশন, লোশন ও ভিটামিন জাতীয় ওষুধ। আর ইনডোর রোগীদের জন্য ২৬১ ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এতে ৮৮টি ইনজেকশন, ১০৩টি ট্যাবলেট, ১২টি ক্যাপসুল, ১৬টি সিরাপ, ৩৭টি বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, দেশের ওষুধের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট বাবুবাজার মিটফোর্ড এলাকা। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরির অন্যতম আখড়াও হচ্ছে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এবং এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ভেজাল ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এখানে কোনো ওষুধ টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা নেই। তবে মিটফোর্ডের কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে জানান, বেশির ভাগ ওষুধ কোম্পানিই এখান থেকে ওষুধের কাঁচামাল কিনে নিয়ে যায়। যে ওষুধগুলোর দাম বেশি ও সহজে পাওয়া যায় না, সেসব ওষুধ ভেজাল করা হয়। ভেজাল কীভাবে করা হয় তা জানতে চাইলে তারা বলেন, আসল ওষুধের কাঁচামালের সঙ্গে খাবার সোডা, আটা, ময়দা, সুজি ও চিনি মিশিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করা হয়। এটি পরীক্ষা ছাড়া ধরা সম্ভব নয়। জানা গেছে, বিক্রয় নিষিদ্ধ সরকারি ওষুধের পাশাপাশি ভেজাল ওষুধের রমরমা বাণিজ্য চলছে। এক শ্রেণির ওষুধ কোম্পানি বেশি মুনাফা লাভের আগায় তৈরি করছে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ওষুধ। এসব ওষুধ সেবন করে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছে জটিল ও কঠিন রোগে। অনেক সময় এসব ওষুধ সেবনে মারাও যাচ্ছে রোগী।  নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওষুধ প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বিভিন্ন সময় নাম সর্বস্ব কোম্পানিকে জেল-জরিমানা করা হলেও তাদের টনক নড়ছে না। নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করে কেউ কেউ কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যালোপ্যাথিক থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদিক সব ওষুধেই মিলছে ভেজাল। ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের এসব ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এসব ওষুধ খেয়ে কিডনি বিকল, বিকলাঙ্গতা, লিভার, মস্তিষ্কের জটিল রোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। এ বিষয়ে একাধিক ওষুধ বিক্রেতা জানান, যারা ওষুধ সম্পর্কে বুঝে না তাদের নকল ওষুধ দেওয়া হয়। আর বেশির ভাগ লোক প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ নেয়। ফলে তাদেরই এসব নকল ওষুধ দেওয়া সহজ হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গত বছরের এক তথ্যে জানা যায়, বিশ্বে ১৫ শতাংশ ওষুধই ভেজাল। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ভেজাল ওষুধ তৈরি হয় ভারতে। নাইজেরিয়ায় ২৩ শতাংশ। আর ১৫ শতাংশ ভেজাল ওষুধ নিয়ে পাকিস্তানের অবস্থান তৃতীয়।

সর্বশেষ খবর