শনিবার, ১০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

হুমকিতে পাটুরিয়া বন্দর

নদীর বালু তোলা আর মাটি কাটার মহোৎসব ঈদে ফেরি চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা

সাঈদুর রহমান রিমন, পাটুরিয়া ঘাট থেকে ফিরে

হুমকিতে পাটুরিয়া বন্দর

মানিকগঞ্জে পদ্মা ও যমুনা নদী থেকে বালু তোলা-মাটি কাটার মহোৎসব শুরু হয়েছে। যত্রতত্র ড্রেজার লাগিয়ে, ভ্যাকু মেশিন বসিয়ে বার্জ, নৌকা আর শত শত ট্রাকে বালু-মাটি বহন হচ্ছে রাত-দিন। এই বালু ও মাটির দেদার বাণিজ্য চললেও সরকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। বরং অবৈধ এ কর্মকাণ্ডের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে পাটুরিয়া নৌবন্দর। আসন্ন ঈদে পাটুরিয়া ফেরিঘাট অচল হওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবহন ও লঞ্চ ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন, পাটুরিয়ার এক নাম্বার ফেরিঘাট ঘেঁষেই উত্তর পাশে নদীসহ তীরবর্তী এলাকায় যে হারে বালু উত্তোলন হচ্ছে তাতে বেশ কয়েকটি গভীর খাদ সৃষ্টি হয়েছে। সেসব স্থানে ইতিমধ্যেই ভাঙনের সূত্রপাত ঘটছে। দীর্ঘদিন ধরে অসাধু ক্ষমতাধর বালু ব্যবসায়ীরা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ড্রেজার বসিয়ে পাইপের মাধ্যমে মাটি ফেলে ভরাট করছে নিচু জমি। স্থানীয়রা বার বার অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। উল্টো উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) মৌখিক আদেশেই বালু উত্তোলনসহ মাটি কেটে নেওয়ার কাজ চলছে বলেও দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে শিবালয় উপজেলার নির্বাহী অফিসার কামাল মোহাম্মদ রাশেদ বলেছেন, অবৈধ বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার বিরুদ্ধে তিনি ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। ইউএনও জানান, আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাটসহ আশপাশের এলাকায় বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে লিপ্ত প্রভাবশালী মাটি বিক্রেতা চক্রের দৌরাত্ম্য থামানো হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া ঘাট এলাকা থেকে জাফরগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ২০টি ড্রেজার বসিয়ে হরদম বালু উত্তোলন চলছে। অন্যদিকে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের আশপাশেই অন্তত পাঁচটি স্থানে চলছে নদীর তীর থেকে মাটি কেটে নেওয়ার ধুম। সে সব স্থানে ভ্যাকু মেশিনের সাহায্যে অনর্গল ঘরঘর শব্দে নদী তীরের মাটি কেটে তা শত শত ট্রাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লুটেরা বালু ব্যবসায়ীরা উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে নদীসীমার সরকারি মাটি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বেপরোয়া মাটি কেটে নেওয়ায় এবারের বর্ষা মৌসুমেই ব্যাপকভাবে নদী ভাঙনের আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা। ওই এলাকায় নতুন করে নদী ভাঙন শুরু হলে ঐতিহ্যবাহী আরিচা বন্দর, শিবালয় বন্দর বাজার, আবহাওয়া অফিস, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, পিসিপোল নির্মাণ প্ল্যান্ট, তেওতা-জাফরগঞ্জ, আরিচা-দাসকান্দি বেড়িবাঁধ কাম সড়ক এবং বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি অফিস, শিবালয় থানা ভবন, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, সরকারি ডাকবাংলো, তিনটি হাইস্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং নদী ঘেঁষা গ্রামগুলো নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শিবালয় বন্দর ব্যবসায়ী সমাজ কল্যাণ সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেন জানান, নদী থেকে মাটি বা বালু উত্তোলন নিষেধ থাকলেও তা কেউ মানছে না। শিবালয় ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের সদস্য রফিকুল ইসলাম জানান, আগে দেখা গেছে নদী থেকে কেউ এক কোদাল মাটি কাটলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ মামলা করত, গ্রেফতার করত।  কিন্তু এবার নিহালপুর এলাকায় ড্রেজার ও ভ্যাকু বসিয়ে দেদার মাটি কেটে জমজমাট বাণিজ্য চললেও কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি জানান, বালু লুটেরাদের পেছনে উপজেলা প্রশাসনের ইন্ধন থাকায় কেউ টু শব্দটি করতেও সাহস পাচ্ছে না। অবৈধ বালু উত্তোলন ও মাটি কাটা বাণিজ্যের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আরিচা নৌবন্দর কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিকার বিধানের জন্য আমরা জেলা প্রশাসক বরাবর দফায় দফায় আবেদন করেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বন্দর ধ্বংসের কর্মকাণ্ড বন্ধ না হলে আমরা কি করতে পারি?’ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে শত শত ট্রাকযোগে মাটি বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলেই মাটি ব্যবসায়ীরা জবাব দেন-উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন প্রকল্পে নেওয়া হচ্ছে মাটি। কিন্তু বাস্তবে উথলী ও টেপরার বিভিন্ন ব্যবসায়ী ঘাট থেকে মাটি-বালু তুলে সরাসরি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। কোনো প্রকল্পে এসব মাটি ও বালু ব্যবহারের নজির দেখা যায়নি। মাটি কাটার অবৈধ নির্দেশ প্রদান প্রসঙ্গে ইউএনও কামাল মোহাম্মদ রাশেদ জানান, প্রকল্প কাজের প্রয়োজনে কোথাও থেকে মাটি সংগ্রহ করা যায় না। তাই বাধ্য হয়েই নদীর বালু আর তীরবর্তী মাটি কেটে নিতে হয়। কিন্তু নৌবন্দর এলাকা থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই মাটি কাটা ও বালু উত্তোলনের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা তিনি রাখেন কি না- সে প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি উপজেলা নির্বাহী অফিসার। 

তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই : কামাল মোহাম্মদ রাশেদ শিবালয় উপজেলা পরিষদে যোগদানের পর থেকেই অনিয়ম দুর্নীতি যেন বাসা বেঁধে আছে। অভিযোগ আছে, ইউএনও নিজে প্রতিটি ড্রেজার ও ভ্যাকু মেশিন থেকে মাসিক বিশ হাজার টাকা হারে চাঁদা আদায় করেন। ধার্য চাঁদা প্রদানে বিলম্ব হলেই তিনি যত্রতত্র মোবাইল কোর্ট বসিয়ে মাটি কাটার মেশিনপত্র জব্দ করেন, মোটা অঙ্কের জরিমানারও আদেশ দেন। মাসোহারা সচল হলেই অবস্থা আবার স্বাভাবিক। তার বিরুদ্ধে গৃহহীনদের ঘর বরাদ্দ দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা লুটে নেওয়া, নিম্নমানের ঘর বানিয়ে লাখ টাকা বরাদ্দের স্থলে প্রায় অর্ধেক টাকাই পকেটস্থ করা। ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া ভিজিএফ কার্ড নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতিটি তিন হাজার টাকা দরে দুস্থ পরিবারে বিক্রির গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিবালয় উপজেলার সব ইউপি চেয়ারম্যান জানান, ইউএনও প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিবারের সন্তান দাবি করে দাপট দেখান। তার তুই তুকারি ব্যবহার ও চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে সবাই ত্যক্ত-বিরক্ত। ইউএনওর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক বৈঠক থেকে জনপ্রতিনিধিরা সবাই একযোগে ওয়াকআউট পর্যন্ত করেছেন। দুর্ব্যবহারের কারণে তার বিরুদ্ধে উপজেলা পরিষদে ঝাড়ু মিছিলসহ বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে। ইউএনওর বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত জীবনী’ বিক্রির নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া নিয়ে। তিনি প্রতি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ১৬ হাজার টাকা করে এবং প্রতিটি স্কুল থেকে ২৫ হাজার টাকা করে প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে নিলেও গত আট মাসেও তারা এক কপি বই পাননি হাতে।

সর্বশেষ খবর