বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঘরে ফিরছে ঢাকার মানুষ

মোস্তফা কাজল

ঈদ ঘনিয়ে আসায় ধীরে ধীরে ফাঁকা হচ্ছে ঢাকা। টার্মিনাল থেকে পথে পথে— সর্বত্র বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ মাথায় নিয়েই ঘরমুখো মানুষ গতকাল থেকে দলে দলে ঢাকা ছাড়ছেন। ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে এই জনস্রোত বাড়তে থাকবে। এ যাত্রার যেন শেষ নেই। রাজধানী ঢাকার যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে এতটুকু সুখ ও শান্তি খুঁজতে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতেই এই কষ্ট। এর পরও ট্রেন, লঞ্চ ও বাসে উঠতে পেরে সবাই খুশি, মুখে তৃপ্তির হাসি। এটাই শাশ্বত বাঙালি মুসলমানের চিরায়ত স্বভাব। নাড়ির টানে ঘরে ফেরা বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের ঐতিহ্য। মা, বাবা, ভাই, বোনসহ আপনজনদের সঙ্গে ঈদের সুখ ও আনন্দ উপভোগের যেন বিকল্প নেই। রেলের শিডিউল বিপর্যয়, এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিলম্বে টার্মিনালে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। চরম অব্যবস্থার মধ্যেও ঠাঁই নেই লঞ্চে—ছাদ থেকে শুরু করে ডেক পর্যন্ত। এখানেও কেউ সময়সূচি মানছে না। এর পরও জনস্রোতের কমতি নেই। কোনো বাধা-বিপত্তিই যেন তাদের আটকে রাখতে পারছে না। নগরীর বাস টার্মিনালগুলোতে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। গাবতলী আন্তনগর বাস টার্মিনালের অনেক টিকিট কাউন্টার গতকাল যাত্রীতে ছিল পূর্ণ। এবার ঈদের ছুটির কারণে সবখানেই অতীতের যে কোনো বছরের তুলনায় ভিড় একটু বেশি।

রেলপথ : সড়কের মতো রেলপথেও শুরু হয়েছে ঈদযাত্রা। গতকাল নির্ধারিত সময়ে স্টেশন ছেড়ে যেতে পারেনি ১১ ট্রেন। এসব ট্রেন ১০ থেকে ২৫ মিনিট দেরিতে ছেড়েছে। আন্তনগর মহানগর প্রভাতি এক্সপ্রেস ১২ মিনিট দেরিতে ছেড়েছে। গতকাল প্রায় ২৫ মিনিট বিলম্বে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যায় মহানগর প্রভাতি। এরপর ২০ মিনিট বিলম্বে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে যায়। অগ্নিবীণা, চিত্রাসহ হরেক নামের ট্রেনের একই সমস্যা। গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলছে ট্রেন। শত চেষ্টা করেও রেল কর্তৃপক্ষ শিডিউল ঠিক রাখতে পারছে না। এই শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে বাড়ি ফেরার জন্য নির্ধারিত সময়ে কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। যারা ১৮-১৯ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অগ্রিম টিকিট কেটেছিলেন, তাদের ভাষ্য, এত দুর্ভোগ আর ভালো লাগে না। টিকিট কাটা হয়ে গেলেও এখন পরিবার-পরিজন ও শিশুদের নিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক আজ কমলাপুর স্টেশন পরিদর্শন করতে আসবেন। রেলসূত্র জানায়, এবারও ঈদে শিডিউল ঠিক রেখে ট্রেন চালানোর চেষ্টা চলছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করেই অনেক ট্রেন ধীরগতিতে চালানো ও বিরতিতে অতিরিক্ত সময় দিতে হচ্ছে। অনেকে জানান, এত কষ্ট করে বাড়ি ফেরায় ঈদের আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। গতকাল কমলাপুর স্টেশনে আসা যাত্রীদের বেশির ভাগকেই বিভিন্ন ট্রেনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। রাজশাহীগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী ডা. নুসরাত জাহান জানান, বেলা ১টায় দুই শিশুসন্তান নিয়ে স্টেশনে এসেছেন। সিল্কসিটি এক্সপ্রেস আড়াইটায় আসার কথা থাকলেও পৌঁছায় প্রায় ২৫ মিনিট পর। ঈদ স্পেশাল পার্বতীপুর এক্সপ্রেসের যাত্রী ঝরনা আক্তার, সেলিম মিয়া, সাব্বির, শিক্ষার্থী লিপি ও লিজা জানান, স্পেশাল ট্রেনের টিকিট কেটেও সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রেনটি বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও পৌনে ৫টা পর্যন্ত স্টেশনেই আসেনি। এদিকে প্রতিটি ট্রেনেই যাত্রীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ট্রেনের নামাজের স্থান ও খাবারের বগিতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। নামাজের স্থান ও খাবারের বগিতে চলে আসন বিক্রির দরকষাকষি। ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বসার জায়গা বিক্রি করা হয়। এদিকে কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী জানান, যেসব ট্রেন বিলম্বে কমলাপুর স্টেশনে আসছে, সেগুলো বিলম্বেই ছাড়তে হচ্ছে। শত চেষ্টায়ও শিডিউল ঠিক রাখা যাচ্ছে না। যাত্রীদের নিরাপত্তায় স্টেশনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্কাবস্থায় রয়েছেন। জয়ন্তিকা, উপকূল ট্রেনের যাত্রীদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন, ট্রেন দুটির প্রায় প্রতিটি বগিতে কিছু ফ্যান ও লাইট নষ্ট রয়েছে। টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী। রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, রেলে বর্তমানে যেসব ইঞ্জিন চলছে, এর প্রায় ৮৫ শতাংই মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে ৬০-৬৫ মাইল গতির বদলে ৩০-৩৫ মাইল গতিতে চালাতে হচ্ছে অধিকাংশ ট্রেন।

 

লঞ্চ টার্মিনাল : গতকাল ভোর থেকে নৌপথে যাত্রীসংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। আজ থেকে স্পেশাল সার্ভিস শুরু হবে। ঈদযাত্রার প্রতিটি নৌযানের কেবিনের টিকেট নেই। তাই ডেকের স্থান দখল নিয়ে নিরন্তর লড়াই চলছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। ডেকে একটু স্থান পেতে ভোরে অনেকে হাজির হচ্ছেন টার্মিনালে। বিপরীত প্রান্ত থেকে কোনো লঞ্চ ঘাটে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরমুখো মানুষ হুড়মুড় করে লঞ্চে চড়ে ডেকের জায়গা দখল করে নিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পন্টুন থেকে নৌকাযোগে নদীর মাঝখানে নোঙর করে রাখা লঞ্চে চড়েও ডেকের জায়গায় নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। এমনই একজন আতাহার হোসেন। দুপুরে সুন্দরবন-৬ লঞ্চে গেলে আলাপকালে তিনি বলেন, সেহরি খাওয়ার পরপরই একজনকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুর থেকে সদরঘাট আসেন। এরপর নৌকায় চড়ে লঞ্চের ডেকের জায়গা দখল করেন। সকাল ১০টার পর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের ডেক প্রাপ্তির খবরটি জানান দিলে তারা টার্মিনালে চলে আসেন। তিনি বলেন, প্রতিবছরই এমন হয়। লঞ্চমালিকের কর্মীরাই চাদর বা পাটি বিছিয়ে ডেকের স্থান দখল করে রাখেন। পরে চড়া দামে ডেকের স্থান বিক্রি করা হয়। ঈদ উপলক্ষে লঞ্চমালিকদের এটাও একটা বাড়তি আয়। হুলারহাট রুটের রাজদূত-৭ লঞ্চের ডেকযাত্রী মিজানুর রহমান শেখ বলেন, ঢাকায় থাকেন যাত্রাবাড়ী থানার মিরহাজীরবাগে। বেলা ৩টা পর্যন্ত দেখা গেছে, যাত্রীতে ভরে গেছে সদরঘাটে নোঙর করা প্রায় অর্ধশত লঞ্চ। ডেকের কোথাও জায়গা খালি নেই। নুসরাত-২, পূবালী-২, মানিক-৫, ঈগল-১, নিউ আল-বোরাক, মডার্ন সান, এমভি টিপু-৫ ও ৬, সুন্দরবন-৬, সৈকত-২ লঞ্চের ছাদেও যাত্রীরা অবস্থান নিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হয়। নুসরাত লঞ্চের এক কর্মী বলেন, বারবার নিষেধ করেও যাত্রীদের ছাদে ওঠা ঠেকানো যাচ্ছে না। হুলারহাট রুটের রাজদূত-৭ লঞ্চের ছাদে যাত্রী না থাকলেও ডেক ছিল ভরা। এর পরও যাত্রী ডাকাডাকি করছিলেন কর্মীরা। এ ব্যাপারে লঞ্চের মালিক ফখরুল আলম বলেন, তার লঞ্চে তখনো ধারণক্ষমতা অনুযায়ী যাত্রী হয়নি। প্রয়োজনীয় যাত্রী হলে লঞ্চটি গন্তব্যে রওনা হবে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ঈদ উপলক্ষে কতিপয় লঞ্চমালিক আইনকানুনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নৌপরিবহনে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ লঞ্চও নামানোর চেষ্টা করছেন তারা।

বাস টার্মিনাল : গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে যাত্রীদের চাপ কিছুটা বেড়েছে। গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলেছে যাত্রীদের আনাগোনা। তবে উপচে পড়া ভিড় হয়নি। দেখা গেছে, বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, বেনাপোল, রাজশাহী জেলার রুটগুলোতে যাত্রী সবচেয়ে বেশি। যাত্রী বেশি হওয়ায় বেড়েছে কুলি ও কলার বয়দের উৎপাত। তারা যাত্রী দেখলেই লাগেজ নিয়ে টানাটানি করছেন। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও রুটগুলোতে লক্কড়-ঝক্কড় বাস নামানো হয়েছে। সিটি সার্ভিসের কিছু বাসও যোগ করা হয়েছে দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহনে। মালিকরা জানিয়েছেন, পথিমধ্যে যানজট হওয়ায় কোনো বাসই বিপরীত প্রান্তে যাত্রী নামিয়ে সময়মতো গাবতলী আসতে পারছে না। অন্যদিকে কালিয়াকৈর চৌরাস্তায় তীব্র যানজটের কারণে দুর্ভোগ বেড়েছে। আজ রাজধানীর মহাখালী ও সায়েদাবাদসহ প্রতিটি বাস টার্মিনালে এ ভিড় আরও বাড়বে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর