বুধবার, ৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়া আতঙ্ক বাড়ছে দুর্ভোগ

জিন্নাতুন নূর

প্রথমদিকে প্রশাসন খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু রাজধানী ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় প্রতিদিন যে হারে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের টনক নড়েছে। রাজধানী ও তার আশেপাশের এলাকার ঘরে ঘরে এখন চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্ক। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) দেওয়া তথ্যে, এখন পর্যন্ত সংস্থাটি সারা দেশে ৫১৩ জন চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করেছে। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা কয়েক হাজার। তারা আরও জানান, এই রোগ পরবর্তী সমস্যাতেই রোগীদের বেশি কষ্ট হয়। রোগ সেরে যাওয়ার পরও রোগীদের অনেককেই টানা দেড়-দুই মাস বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগতে হয়। অনেকের পলি আর্থাইটিস (গাঁটে ব্যথা) হয়।

আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকেও চিকুনগুনিয়া রোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে। গত সোমবার সচিবালয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন আশ্বাসও দিয়েছেন, আগামী চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যেই চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন দেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব স্থায়ী হবে। আগামী বছরগুলোতে দেশের অন্য জেলাগুলোতেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, চিকুনগুনিয়া সাধারণত ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকা যেখানে বড় বড় দালান আছে সেখানে বেশি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ রোগে আক্রান্তরা চার-পাঁচ দিন তীব্র জ্বরে ভোগেন। এ সময় তাদের শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। আক্রান্তদের হাঁটাচলায় সমস্যা হয়। তবে এ রোগ-পরবর্তী সমস্যায় রোগীদের বেশি কষ্ট হয় বলে এই চিকিৎসক মন্তব্য করেন। রোগ সেরে যাওয়ার পরও রোগীদের অনেককেই টানা দেড়-দুই মাস বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগতে হয়। অনেকের পলি আর্থাইটিস হয়। আইইডিসিআরের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা পরীক্ষা করে গড়ে সপ্তাহে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত সাত থেকে ১০টি রোগী পাচ্ছেন। কিন্তু এর বাইরেও আরও অনেক আক্রান্ত রোগী আছে বলে সংস্থাটির কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। চিকিৎসকদের মতে, এ রোগে আক্রান্তদের জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষেধক এখনো নেই। এ জন্য জ্বর ও শরীরের ব্যথা কমাতে এখন পর্যন্ত রোগীদের তারা প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। চিকুনগুনিয়া রোগ শেষেও অনেক রোগীকে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে। আক্রান্ত অনেক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ রোগ সেরে যাওয়ার পরও তারা শরীর ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, ব্যথার জন্য হাঁটাচলায় সমস্যা অনুভব করছেন। অনেকের পায়ের পাতা ফুলে গেছে। এর বাইরে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের অনেকেরই পলি আর্থাইটিস হচ্ছে। এর ফলে শরীরের গাঁটে অসহ্য ব্যথা অনুভূত হয়। ওজন কমে যায়, শরীরের বিভিন্ন অংশে র‌্যাশ দেখা দেয়, গলায় ব্যথা অনুভূত হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে এখন পর্যন্ত দেশে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কোনো রোগীর মৃত্যুর খবর নেই।  তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আগে থেকে হৃদরোগ ও কিডনি সমস্যার মতো গুরুতর রোগী চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুঝুঁকির আশঙ্কা আছে।

ঘরে ঘরে আতঙ্ক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোবাইদ আহমেদের ছোটবেলা থেকেই মশারি ছাড়া ঘুমানোর অভ্যাস। মশারির নিচে তার নাকি ঘুম আসে না। কিন্তু এক মাস যাবৎ তিনি মশারি টাঙিয়েই ঘুমাচ্ছেন। কারণ চিকুনগুনিয়া নামক মশাবাহিত রোগে প্রায় দুই সপ্তাহ অসুস্থ থাকার পর এখনো এ রোগ পরবর্তী সমস্যাগুলো এই শিক্ষার্থীকে কাহিল করে ফেলেছে। তিনি এতই আতঙ্কিত যে, জীবনে আর কখনো মশারি ছাড়া ঘুমাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জোবাইদের মতো ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকাগুলোতেও চিকুনগুনিয়ায় যারা আক্রান্ত এবং যারা এখনো আক্রান্ত হননি উভয়পক্ষই আতঙ্কের কারণে এখন মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতা মেনে চলছেন। এই আতঙ্কের জন্য মশারির দোকানগুলোতে বেড়েছে মশারি বিক্রি, কয়েল ও মশার স্প্রের বিক্রিও তুঙ্গে। এমনকি যারা সাধারণ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন তারাও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এই ভয়ে চিকিৎসকের কাছে ছুটছেন।

চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে রিট : চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুজাউদ্দৌলা আকন্দ হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন। পরে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে রিট আবেদন উপস্থাপন করা হয়। রিট সম্পর্কে আবেদনকারী আইনজীবী বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের যেসব স্থানে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব রয়েছে, সেসব স্থানে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিট আবেদনে।

স্বাস্থ্য সচিব, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে রিটে বিবাদী করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর