বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

নিয়ন্ত্রণহীন চিকুনগুনিয়া

রোগীর সংখ্যা নির্ণয়ে শুরু হয়েছে জরিপ বাড়তি সতর্কতায় মন্ত্রণালয়

জয়শ্রী ভাদুড়ী

নিয়ন্ত্রণহীন চিকুনগুনিয়া

‘রাত প্রায় ২টা। তিন বছরের ছেলে সোহানের গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। জ্বরের ঘোরে আর যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে ছেলে। এদিকে আমিসহ পাঁচ সদস্যের পরিবারের সবাই চিকুনগুনিয়ায় শয্যাশায়ী। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য নেই শরীরে। শেষে আমার প্রতিবেশী এসে ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।’ শুধু কলাবাগানের বাসিন্দা শাহরিয়ার হোসেন নন, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ঘরেই হানা দিয়েছে চিকুনগুনিয়া। এ পর্যন্ত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পরীক্ষা করাতে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে ৫১৩ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি।

চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা জানতে জরিপ : একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পরই একে একে পরিবারের অন্য সদস্যদের শরীরে বাসা বাঁধে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক এই ব্যাধি। কিন্তু রোগের উপসর্গ দেখে অনেকেই যাননি পরীক্ষা করাতে। তাই সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কারও কাছেই নেই প্রকৃত সংখ্যা। এজন্য আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নির্ধারণে জরিপ শুরু করেছে আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘গত তিন মাসে ৬৪৩ জনের রক্ত ও লালার নমুনা পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। এর মধ্যে ৫১৩ জন চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। দেশে একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানেই চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করার প্রযুক্তি আছে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা জানার জন্য জরিপ শুরু করেছি। এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার প্রভাব থাকবে।’ আর ঈদে বাড়ি যাওয়ার কারণে সারা দেশে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে বলে জানান তিনি।

পর্যাপ্ত নয় মশার ওষুধ : সিটি করপোরেশন থেকে যে ওষুধ ছিটানো হয় তা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। অনেক এলাকায় দেখা মেলে না মশক নিধন কর্মীর। উত্তরার বাসিন্দা রফিক আলী বলেন, ‘আগে মাঝে মাঝে দেখতাম মশার ওষুধ স্প্রে করতে কিন্তু দুই মাস হচ্ছে এ এলাকায় স্প্রেম্যান দেখি না।’ ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিধন কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ডিএনসিসি এলাকার কাউন্সিলররাও। ২১ জুন ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা ওই কাজের দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানান। এরপর মেয়রের সিদ্ধান্তে গত রবিবার কাউন্সিলরদের হাতে এ দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়েছে। ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির বাজেট বই থেকে দেখা যায়, ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ডিএনসিসি মশক নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ রেখেছে ২০ কোটি টাকা। ডিএসসিসির বাজেট এখনো ঘোষণা করা হয়নি। বিদায়ী অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ খাতে ডিএসসিসির বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ওই খাতে ডিএনসিসির বরাদ্দ ছিল ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে ছিল ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। মশক নিয়ন্ত্রণে এত অর্থ বরাদ্দ থাকলেও এর সুফল দেখা যায় না। এ ছাড়া মশার ওষুধের মান নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তবে দুই সিটি করপোরেশনের দাবি, মশার ওষুধ নিয়মমাফিক ছিটানো হয়। কিন্তু পাশের এলাকা বা জলাবদ্ধ এলাকা থেকে প্রচুর মশা এসব এলাকায় আসে। ফলে ওষুধ ছিটানো হলেও অনেক এলাকায় মশা বেশি থাকে।

এ ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, ‘আমরা পাঁচটি জোনে ভাগ করে মেডিসিন দিয়ে থাকি। দুই বেলা মশার ওষুধ স্প্রে করা হয়। সকালে লার্ভা সাইজের জন্য এবং অ্যাডাল্ট সাইজের জন্য। প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২-৫ সিসি পরিমাণে ওষুধ মেশানো হয়। এর চেয়ে বেশি মেশালে মানুষ এবং প্রাণিকুলের ক্ষতি হবে। কাজে অগ্রগতি আনতে এখন থেকে এলাকার কাউন্সিলরদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি আরও পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে।’

বাড়তি সতর্কতায় মন্ত্রণালয় : চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। এ দুই মাসে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রীর সভাপতিত্বে দুই সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তি এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে সারা দেশে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার (চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণকক্ষ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করার জন্য একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। জনসাধারণের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সার্বক্ষণিক হটলাইন চালু করা হয়েছে। এ সম্পর্কিত তথ্য জানতে ও জানাতে ০১৯৩৭১১০০১১, ০১৯৩৭০০০০১১ নম্বরে যোগাযোগ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালের পাঁচ শতাধিক ডাক্তার, নার্সকে চিকুনগুনিয়া বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৫টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইমামদের মাধ্যমে অবহিতকরণ ও সচেতনতামূলক সভা পরিচালনা করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের উদ্যোগে মানুষকে সচেতন করতে এবং সেবা দিতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ।

যেভাবে দেশে এলো চিকুনগুনিয়া : ১৯৫২ সালে তানজানিয়া ও মোজাম্বিকের সীমান্ত এলাকায় প্রথমবার এ জ্বরের দেখা মেলে। রোগীদের দুমড়ে মুচড়ে শয্যাশায়ী করে ফেলে এ রোগ। তাই এই লক্ষণের জন্য সীমান্ত এলাকার স্থানীয় ভাষায় এর নাম রাখা হয় চিকুনগুনিয়া। পরে আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকা ও ভারতে এর দেখা মেলে। ২০০৫ সালে ভারতে চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক প্রকোপ দেখা দেয়। তখন এক দফা সমীক্ষা চালানো হলেও বাংলাদেশে আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীর দেখা মেলে। ২০১১ সালে আবারও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঢাকার দোহারে এর প্রকোপ দেখা দেয়।

চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞ মতামত : চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন ড. এ বি এম আবদুল্লাহ কিছু বিষয় খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ব্যথা আর নানা উপসর্গের কারণে সহজেই বোঝা যাচ্ছে চিকুনগুনিয়ার প্রভাব। তিন থেকে চার দিনের মধ্যে জ্বর সেরে উঠলেও হাড়ের জোড়ের ব্যথায় রোগীরা নাজেহাল। তবে ভয়ের কিছু নেই। চিকুনগুনিয়া সন্দেহ হলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রোগীর রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি দেখা হয়। এতে ২ থেকে ১২ দিন লাগতে পারে। চিকুনগুনিয়ার কোনো প্রতিষেধক নেই। এর চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলোকে নিরাময় করা। রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল খেতে দিতে হবে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট, এর সঙ্গে সঙ্গে পানি দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। তীব্র ব্যথার জন্য এসপিরিন না দেওয়াই ভালো। আবার যেন মশায় না কামড়ায় এজন্য রোগীকে মশারির ভিতরে রাখাই ভালো। কারণ আক্রান্ত রোগীকে মশায় কামড় দিয়ে কোনো সুস্থ লোককে সেই মশা কামড় দিলে ওই ব্যক্তিও এ রোগে আক্রান্ত হবেন। অনেকের এই রোগে আক্রান্তের পর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে নতুন অন্য অসুখ সংক্রমণ করতে পারে। তাই সাবধান থাকতে হবে এবং প্রচুর তরল ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, পরিচ্ছন্নতা বোধ এবং যথেষ্ট বিশ্রাম এই ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর