বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ছোট হচ্ছে সুন্দরবন

৩৭ বছরে হারিয়ে গেছে ১৪৪ বর্গ কিলোমিটার

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

ছোট হচ্ছে সুন্দরবন

ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের আয়তন প্রতি বছরই কমছে। উজানে মিঠা পানির প্রবাহ কমার ফলে তীব্র লবণাক্ততা, সমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ে ভাঙন ও দখলদারদের কবলে পড়ে  গত ৩৭ বছরে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার আয়তন হারিয়ে গেছে সুন্দরবনের। আর সুন্দরবনের পাশের ১০ কিলোমিটারজুড়ে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’র (ইসিএ) বনভূমির কী পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়েছে তার হিসাব নেই। পরিবেশ গবেষকরা বলছেন, দেশের ৫১ ভাগ বনাঞ্চলের এই সুন্দরবন জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাভূমি। ওই কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনে আন্তর্জাতিক শর্তানুযায়ী সুন্দরবনের ক্ষতি হতে পারে, এমন কোনো তৎপরতা চালাতে পারে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেনসিং অর্গানাইজেশনের (স্পারসো) ‘টাইম সিরিজ অ্যানালাইসিস অব কোস্টাল ইরোশন ইন দ্য সুন্দরবনস ম্যানগ্রোভ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হচ্ছে, ম্যানগ্রোভের চিরায়ত রীতি অনুযায়ী যতটুকু নতুন করে চর পড়ে বন গড়ে উঠেছে, তার চেয়ে বেশি ভাঙছে। এই ৩৭ বছরে নতুনভাবে চর জেগেছে মাত্র ১০৪ বর্গকিলোমিটার, আর ভাঙনের কারণে সুন্দরবন তার আয়তন হারিয়েছে ২৩৩ বর্গকিলোমিটার। আবার ভাঙার হার পুব দিকের চেয়ে পশ্চিম দিকে অনেক বেশি। স্পারসোর এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সালের তুলনায় ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালে বন কমেছে সবচেয়ে বেশি। স্বাধীনতা-পরবর্তী থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বেড়েছে ২৯ বর্গকিলোমিটার হারে। আবার একই সময়ে আয়তন হারিয়েছে ৩২ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে ১৯৯০ থেকে ২০১০ সময়কালে সুন্দরবনের আয়তন বেড়েছে বছরে মাত্র ৬ বর্গকিলোমিটার হারে। এ সময়ে আয়তন হারিয়েছে ৪২ বর্গকিলোমিটার। শুধু ভাঙনের কারণেই প্রতি বছর ৬ বর্গকিলোমিটার করে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবন। ’৭৩ সালের পর মাত্র ৩৭ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার। গবেষকদের ধারণা, উজানের ফারাক্কা বাঁধের কারণে নদীগুলোর ক্ষীণ প্রবাহ ও সমুদ্র স্রোতের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে ভাঙা-গড়ার ব্যবধান বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনেরও প্রভাব রয়েছে। ভাঙা-গড়ার এই প্রবণতা স্থায়ী হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ ম্যানগ্রোভ বনটির বাংলাদেশ অংশ আরও সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা বেড়েই চলেছে।

১০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের বাংলাদেশে অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাঙা-গড়ার মধ্যে আয়তনে ছোট হয়ে আসার পাশাপাশি সুন্দরবনের আশপাশে নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভূমি অধিগ্রহণ ও মানুষের অবাধ বিচরণের কারণে এ বনটি তার বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হলেও পরিবেশ অধিদফতর ওসব এলাকাতেই ১৫০টি প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে। এসবের কারণে সুন্দরবনের আয়তন কমার পাশাপাশি কমেছে গাছ ও প্রাণী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণামতে, ১৯৫৯ সালে সুন্দরবনের প্রতি হেক্টরে সুন্দরি গাছের সংখ্যা ছিল ২১১। কিন্তু ’৮৩ সালে ১২৫ ও ’৯৬ সালে তা ১০৬-এ নেমে এসেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা নেমে আসতে পারে ৮০-তে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে মূলত উজানে মিঠা পানির প্রবাহ কমা ও মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে সুন্দরবনে গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। এর কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে বা প্রাণ-প্রকৃতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনেরও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরবন বাঁচিয়ে রাখার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মোহম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, ‘আমাদের সামনে আর কোনো পথ নেই। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচাতে হলে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ এই সুন্দরবনকে ম্যানগ্রোভ বনের মতো করেই স্বভাবিক নিয়মে থাকতে দিতে হবে।’ সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি তীব্র লবণাক্ততা, সমুদ্রের প্রবল ঢেউ, নদী ভাঙনের কারণেই শুধু সুন্দরবন সংকুচিত হচ্ছে না। সরকারের উদাসীনতা ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে সুন্দরবনের জলজ ও বনজ প্রাণীসহ জীববৈচিত্র্যের সব থেকে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। সুন্দরবনে অস্তিত্ব রক্ষায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণী শিকার রোধ করতে হবে। এ ছাড়া মাছের অভয়াশ্রম ও খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ এবং কাঠসহ সুন্দরবনের সম্পদ পাচার রোধ ও দখলদার ভূমি-আগুনদস্যু এবং চোরা শিকারিদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষতি এড়াতে জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনের আন্তর্জাতিক শর্তানুযায়ী সুন্দরবনের পাশের ১০ কিলোমিটারজুড়ে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’য় (ইসিএ) আর শিল্প কারখানা গড়তে দেওয়া চলবে না। ইতিমধ্যে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানাসহ মংলা বন্দরে আগত সব জাহাজের বর্জ্য শোধনাগারে শোধন করেই সেই পানি নদীতে ছাড়তে হবে। এ প্রসঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনের কোলঘেঁষে আর কোনো ধরনের শিল্প কারখানা স্থাপন করতে দেওয়া চলবে না। শিল্পবর্জ্য ও ধোঁয়া যে বনের ভয়াবহ ক্ষতি করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমের ক্ষতি বন্ধ করতে হবে।’ বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. জাহিদুল কবির মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে প্রতি বছর সুন্দরবনের আয়তন যে পরিমাণ কমছে, সেই পরিমাণ নতুন বন গড়ছে না। গভীর সমুদ্রের ঢেউ ও নদী ভাঙনের কারণে সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ভাঙনের মাত্রা অনেক বেশি। এ কারণে প্রতি বছর কিছু বনভূমি কমছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ধরনের শিল্প কারখানা থাকলে তার প্রভাব অবশ্যই সুন্দরবনের ওপর পড়ছে। এসব কারণে সুন্দরবন সংকুচিত হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর