বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি ১৩ জেলায়

প্রতিদিন ডেস্ক

বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি ১৩ জেলায়

রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক গতকাল পানিতে তলিয়ে যায় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

চলতি বন্যায় দেশের ১৩ জেলায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন। তিনি গতকাল সচিবালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।

মন্ত্রী উল্লেখ করেন, উত্তরের পানি মধ্যাঞ্চলে নেমে এলে আরও নতুন জেলা প্লাবিত হতে পারে। মঙ্গলবার পর্যন্ত ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ১২টিতে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং ৫৫টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পায়। মন্ত্রী জানান, সিলেট, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ জেলা বর্তমানে বন্যাকবলিত। উত্তরের পানি মধ্যাঞ্চলে নেমে এলে আরও নতুন জেলা প্লাবিত হতে পারে। আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি ও প্রতিবেদকদের পাঠানো বন্যা পরিস্থিতির খবর : গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির গতকাল আরও অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের পানি ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া করতোয়া ও তিস্তার পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছিল। বন্যাকবলিত সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক বানভাসি মানুষ খাবারের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে পড়েছে। বন্যার পানিতে প্লাবিত ওই চার উপজেলার ১৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ও সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত চার উপজেলায় ৮২টি সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টিতে বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন। এদিকে বানের দুর্ভোগের সঙ্গে তীব্র হয়েছে নদী ভাঙন। গত চার দিনে সদরের কামারজানি, ফুলছড়ির ফজলুপুর ও উড়িয়া ইউনিয়নে দেড় শতাধিক পরিবার ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে। এসব এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফুলছড়ির উড়িয়া ইউনিয়নের পূর্ব রতনপুর গ্রামের লাকী বেগম জানান, এক সপ্তাহ ধরে তারা পানিবন্দি। ছেলেমেয়েদের মামার বাড়ি পাঠিয়েছেন। বাড়িঘর নিয়ে বহু কষ্টে কোমর পানিতেই আছেন স্বামী-স্ত্রী। শুকনো খাবার বলতে ঘরে তেমন কিছু নেই। খাবার যাই হোক, টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় বেশি কষ্টে আছেন তারা। কিন্তু তারপরও বিশুদ্ধ পানির অন্য কোনো উৎস না থাকায় ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলের পানি দিয়েই চলছে নিত্যদিনের কাজকর্ম। রোগব্যাধি হতে পারে জানা সত্ত্বেও ওই টিউবওয়েলের পানিই পান করতে হচ্ছে। উড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহাতাব উদ্দিন জানান, উপজেলার বিপুলসংখ্যক বানভাসি মানুষের জন্য এই ত্রাণ একেবারেই অপ্রতুল। তার ইউনিয়নের দেড় হাজার বানভাসি মানুষের বিপরীতে ২০০ মানুষের জন্য ১০ কেজি করে মাত্র ২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন সুইট জানান, তার ইউনিয়নে সাত হাজার মানুষ পানিবন্দী হলেও মাত্র দেড়শ মানুষের জন্য ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যদিকে নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি অংশে কাতলামারী, সিংড়িয়া ও রতনপুরসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাঁধের নিরাপত্তায় বেশ কয়েকটি পয়েন্টে পুলিশ ও এলাকাবাসী দিনরাত টহল দিচ্ছে। এলাকাবাসীর আশঙ্কা বাঁধটি ভেঙে গেলে ফুলছড়ি উপজেলা হেডকোয়ার্টারসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। বগুড়া : বগুড়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন করে প্রায় ২০টি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। নদী এলাকার মানুষ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় স্কুলে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে বানভাসিরা। সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানি ১৬ সেন্টিমিটার বেড়েছে। গতকাল যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জানা গেছে, সারিয়াকান্দির কুতুবপুর, বয়রাকান্দি, চন্দনবাইশা এবং কামালপুর ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এসব ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। ঘরে ঘরে পানি ওঠায় বানভাসিরা নিজের জায়গাজমি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেওয়া স্থানে গৃহপালিত পশু ও পরিবারের সদস্যরা একস্থানে দিনাতিপাত করছে। খেতে খামারে কাজ করলেও অনেক বানভাসি কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ সহযোগিতা দেওয়া হলেও বানভাসিরা বলছেন, চাহিদামতো তারা ত্রাণ পাচ্ছেন না। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, মঙ্গলবার বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর গতকাল পানি কমার আশা করা হলেও উজানে ভারি বর্ষণের কারণে আবারও পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে যমুনা তীরবর্তী সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার নতুন নতুন এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। লালমনিরহাট : লালমনিরহাটের দোয়ানী পয়েন্টে গতকাল সকালে তিস্তা নদীর পানি কমে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তার পানির তোড়ে জেলার আদিতমারী উপজেলার নদীরক্ষা কুটিরপাড় বাঁধের ৪০০ মিটার ধসে গিয়ে কয়েক হাজার পরিবার প্লাবিত হয়েছে। এদিকে ৪ দিন থেকে চরাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী থাকলেও অধিকাংশ চরেই পৌঁছেনি ত্রাণ কিংবা সাহায্য। ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী সকালে চরবৈরাতি এলাকায় ৪০০ বানভাসি পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করলেও ৬৩ চরের অধিকাংশ দুর্গত মানুষই পাননি। চার দিন ধরে পানিবন্দী রয়েছে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুরনা, ডাউয়াবাড়ি, গড্ডিমারী, পাটিকাপাড়া, চর গড্ডিমারী, কালীগঞ্জ উপজেলার কালিকাপুর, চরবৈরাতী, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা, গোবর্ধন, কুটির পার ও সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, মোগলহাট, কুলাঘাটসহ নদী তীরবর্তী ১৬টি ইউনিয়নের ৩৬টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ। এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট ও স্কুল-কলেজ। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও তীব্র খাদ্য সংকট। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ভারত তাদের গজলডোবা ব্যারাজের ১০টি জলকপাট বন্ধ করে দেওয়ায় তিস্তার পানি প্রবাহ কিছুটা কমেছে। নীলফামারী : জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলায় তিস্তা নদীর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। গতকাল দুপুরে জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের পূর্বছাতনাই গ্রামে তিস্তা নদীর স্পারবাঁধে সাতশজনের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালেদ রহীম। উল্লেখ্য, গত সোমবার ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে জেলার ডিমলা উপজেলার ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছচাপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার, গোলমাণ্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী ৩০ গ্রামের ১০ সহস্রাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। জামালপুর : জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার রায় গতকাল জানিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টায় যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইদহ জামালপুর জেলার সব নদীর পানি বেড়েছে। সকালে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই পয়েন্টে মঙ্গলবার যমুনার পানি ছিল বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপরে। ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১৬ সেন্টিমিটার। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও জামালপুর সদরের আরও ১৫টি ইউনিয়ন নতুন করে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। সব মিলিয়ে জেলার ৬টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ১৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। টানা বন্যায় পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। দুর্গত অনেক মানুষের ঘরেই খাবার নেই। তার ওপর নিজেদের গবাদিপশুর খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। সিরাজগঞ্জ : ‘ভোটের সময় চেয়ারম্যান-মেম্বররা মা-খালা করে হাতে পায়ে ধরে ভোট নেয়। আর বিপদে তাদের কাছে পাওয়া যায় না। সাত দিন ধরে পানিবন্দী হয়ে রয়েছি। বাড়িতে থাকতে না পারায় বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু একবারও খোঁজখবর নেয়নি।’ গতকাল এমন কথা বললেন খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের বামনবয়ড়া গ্রামের আমেলা খাতুন। একই কথা বললেন, একই গ্রামের আবুল কালাম ও সুমিখাতুন। যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বামনবয়ড়া ও শৈলাবাড়ী গ্রামের কয়েক শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি সহায়তা তাদের কাছে পৌঁছায়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগও বাড়ছে। পানিবন্দী এলাকায় শুকনো খাবার ও পানি সংকট দেখা দিয়েছে। সরকার থেকে যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এরই মধ্যে জেলার ৩০টি ইউনিয়নের ১৩৫ গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে ২০ হাজার পরিবারের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। প্রায় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় ছাত্রছাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর