সোমবার ভোররাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত টানা বর্ষণে ডুবে গেছে রাজধানীর অনেক এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে অভিজাত ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়ক, আসাদ গেট, মানিক মিয়া এভিনিউ, লালমাটিয়া থেকে শুরু করে মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া পর্বতা, খিলক্ষেত, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, আরামবাগ, বাড্ডা, রামপুরা, কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও, কাকরাইল ও পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা। টানা বর্ষণে নগরীর ব্যস্ততম এসব এলাকা থৈ থৈ পানিতে ডুবে থাকায় দিনভর ভোগান্তি ছিল নগরবাসীর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তীব্র যানজট।
গতকাল সরেজমিন ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, আসাদ গেট ও মোহাম্মদপুর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বৃষ্টির পানি জমে যাওয়ার কারণে এসব এলাকায় রাস্তায় কোথাও হাঁটুসমান, কোথাও কোমর পানি জমে গিয়েছিল। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর থেকে শুরু করে আসাদ গেট পর্যন্ত সড়কে ছিল কোমরপানি। সকালবেলা অফিসগামী লোকজন ও স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে কঠিন বিড়ম্বনায় পড়েন অভিভাবকরা। সকাল ৭টার আগে থেকেই ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর থেকে আসাদ গেট, লালমাটিয়া ‘এ’ ও ‘বি’ ব্লকের বিভিন্ন সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় রাস্তায় বের হওয়া যানবাহন, বিশেষ করে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার ইঞ্জিন বিকল হয়ে আটকা পড়ে। আসাদ গেট আড়ং থেকে লালমাটিয়া ‘বি’ ব্লকের ৪ নম্বর গেট ছাড়িয়ে পানি আরও ভিতরে প্রবেশ করে। একইভাবে ‘এ’ ব্লকে অবস্থিত ওয়াসার আঞ্চলিক দফতরে পানি ঢুকে পড়ে। এসব কারণে মিরপুর-নিউমার্কেট সড়ক ছাড়িয়ে যানজট লেগে যায় অলিগলিতে। লালমাটিয়া ও ধানমন্ডি এলাকার প্রতিটি সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনের জট ছিল। জলজটের কারণে বেলা দেড়টা পর্যন্ত এসব এলাকার সড়কগুলোতে যানজট লেগে ছিল। সরেজমিনে দেখা গেছে, ২৭ নম্বর থেকে আসাদ গেট পর্যন্ত প্রধান সড়কে অসংখ্য গাড়ি বিকল হয়ে পড়েছে। পানির মধ্যে ঠেলে ঠেলে বিকল গাড়িগুলোকে নিয়ে যাচ্ছিলেন চালক ও যাত্রীরা। কোথাও কোথাও পুলিশকে দেখা গেছে গাড়ি ঠেলতে। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে একটি পণ্যবোঝাই ট্রাক রাস্তা ছেড়ে উঠে পড়ে ফুটপাথে। এতে ড্রেনের ঢাকনা ভেঙে গাড়িটি অর্ধেকের বেশি কাত হয়ে যায়। অনেক প্রাইভেট কারের ভিতরে পানি প্রবেশ করায় যাত্রীরা গাড়ির ভিতরই ভিজে যান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাবতলী-নিউমার্কেট সড়কে তীব্র যানজট তৈরি হয়। কোনো দিকেই গাড়ি চলাচল করতে না পারায় স্থির হয়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একপর্যায়ে সকাল ৯টার দিকে ট্রাফিক পুলিশ আড়ংয়ের সামনে নিউমার্কেট অভিমুখী সড়কে ব্যারিকেড তৈরি করে যান চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দেয়। বেলা ১১টার দিকে পানি কিছুটা কমলে গাবতলীর দিক থেকে নিউমার্কেট অভিমুখে আসা যানবাহনকে মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। জলাবদ্ধতা ও যানজটের শিকার লোকজনের অভিযোগ, বর্ষা মৌসুমে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ায় বৃষ্টির পানি জমে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এমন বেহাল দশার সৃষ্টি হয়েছে। আসাদ গেট, মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়া এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের পানি নিষ্কাশনের জন্য কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে ২৭ নম্বর থেকে গাবতলী পর্যন্ত নতুন করে ড্রেন নির্মাণ করলেও এর সুফল পাওয়া যায়নি। বরং পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ভোগান্তি বেড়েছে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে সড়কগুলোতে উঠে এসেছে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি। ধানমন্ডির মতো একই অবস্থা খিলগাঁও. শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, আরামবাগ, মতিঝিল, গোড়ান, বাসাবো, মাদারটেক, ভূঁইয়াপাড়া, নন্দীপাড়া, মেরাদিয়া, বাড্ডা, রামপুরা, কারওয়ান বাজার, মিরপুর-১০, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, খিলগাঁও, কাকরাইল ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার। এসব এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণেই এসব এলাকার মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এই জলজটের কারণে নগরীতে গতকাল সকাল থেকেই যানজট লেগে যায়, যা দিনজুড়ে ছিল বিদ্যমান। নগরীর বিভিন্ন এলাকা বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকলেও সেই পানি নিষ্কাশনের জন্য কোথাও ঢাকা ওয়াসার তত্পরতা চোখে পড়েনি।
এদিকে বৃষ্টির পানিতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ডুবে যাওয়ায় এবং এর ফলে যানজট সৃষ্টি হওয়ায় গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকে। সিরাজুস সালেকিন নামের একজন লিখেছেন, ‘রাতে মাত্র ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তাতেই মিরপুর রোড ব্লক। এক ঘণ্টা হচ্ছে বাসে বসে আছি। ২০০ গজ এগোতে পারিনি। জানি না পুরো শহরের কী অবস্থা! বৃষ্টির মাত্রা ১২০ হলে কী হতে পারে সে চিন্তা আর করতে পারছি না! দিন দিন সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা বাড়ে। আমাদের কমছে।’ ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা কাজী আনিছ ফেসবুকে জলাবদ্ধতা নিয়ে লিখেছেন, ‘‘সকালে শিক্ষার্থী সুপ্রিয় শিকদারের ফোন। অপর প্রান্তে আতঙ্ক টের পাচ্ছি। ‘স্যার, আপনি কোথায়?’ ‘এই তো বের হচ্ছি। ভার্সিটি পৌঁছব।’ ‘এখন বের হইয়েন না স্যার।’ ‘কেন?’ ‘স্যার, আপনার বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছি। ৩২ নম্বর পর্যন্ত জ্যাম। রাস্তায় পানি আর পানি। এক ঘণ্টা ধরে বসে আছি এক জায়গায় স্যার’।’’জলমগ্ন রাজশাহী : নিজস্ব প্রতিবেদক রাজশাহী থেকে জানান, রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতে নগরীতে ভেসে গেছে রাস্তাঘাট। নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি উঠেছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকা। প্লাবিত হয়েছে পদ্মার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল। বৃষ্টিপাতে নগরীর কোর্ট এলাকা, বুলনপুর, হড়গ্রাম মতিহারের বিভিন্ন মহল্লা ও অভিজাতদের বাসস্থান উপশহর এলাকাসহ নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় পানি থৈ থৈ করছে। ফলে দুর্ভোগের নগর জীবন। সাহেববাজার জিরোপয়েন্টেও ছিল হাঁটুপানি। রাজশাহী আবহাওয়া অফিস জানায়, এ বছরের রেকর্ড বৃষ্টিপাত এটি। বুধবার বেলা ১টা পর্যন্ত রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১১৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার। মঙ্গলবার রাত ১টা ২০ মিনিট থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে নগরীর উপশহর, আরএমপির সদর দফতর, বিনোদপুর, মতিহার, বুধপাড়া, ডাশমারী, কাজলা, লক্ষ্মীপুর, ডিঙ্গাডোবা, গুড়িপাড়া, মহিষবাথান, সিপাইপাড়া, ভদ্রাসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
কোথাও কোথাও হাঁটু থেকে কোমরপানি জমে গেছে।
নগরীতে গত পাঁচ বছরে এমন জলাবদ্ধতা ছিল না। উপশহর এলাকার সেকেন্দার আলী জানান, অভিজাত এলাকায় বসবাস করেও তাদের হাঁটুপানি মাড়িয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। রাসিকের ড্রেনগুলো সচল না থাকায় পানি নামছে না। রাসিকের কর্মচারীরা আন্দোলনে থাকায় চার দিন ধরে তারা কাজ করছেন না। ফলে ভোগান্তি আরও বেড়েছে মানুষের।
রাসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন জানান, জলাবদ্ধতা দূর করতে কয়েক দিন আগেই ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু ভারি বৃষ্টিপাত ও পদ্মায় পানি বেড়ে যাওয়ায় নামতে সময় লাগছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম জানান, এ বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এমন বৃষ্টিপাত আরও একদিন থাকতে পারে।