শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বসতভিটায় ফিরছে আশ্রয় শিবিরে থাকা পরিবারগুলো

মাহমুদ আজহার ও ফাতেমা জান্নাত মুমু, রাঙামাটি থেকে ফিরে

বসতভিটায় ফিরছে আশ্রয় শিবিরে থাকা পরিবারগুলো

পাহাড় ধসের পর আশ্রয় কেন্দ্রে একটি পরিবার —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আশ্রয়শিবির থেকে নিজ নিজ বসতভিটায় ফিরতে শুরু করেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সেই ক্ষত-বিক্ষত বসতভিটায় গেলেও বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনেকে আবার ফিরে আসছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। অর্থাৎ যাওয়া-আসার মধ্যে রয়েছেন প্রায় সাড়ে ৩ হাজার নারী-পুরুষ। তবে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা পরিবারগুলোতে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের দিন কাটছে। সম্প্রতি কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে এসে এমন চিত্রই দেখা গেছে। পাহাড়ধসে ১২০ জনের মৃত্যুর পর গতকাল একমাস পূর্ণ হয়েছে। 

জানা যায়, আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১ হাজারের মতো শিশু রয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এখন প্রায় সবারই পড়াশোনা বন্ধ। অসুখে-বিসুখে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছোট ছোট কক্ষে গাদাগাদি করে মেঝেতে, বেঞ্চে বা চেয়ারে শুয়ে-ঘুমিয়ে দিন কাটছে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা নারী, পুরুষ ও শিশুদের। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো তা শুরু হয়নি। রাঙামাটিতে মোট আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ১৯টি। পাহাড় ধসের পর ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—রাঙামাটি সরকারি কলেজ, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা পাসপোর্ট অফিস, টেলিভিশন কেন্দ্র, বেতার কেন্দ্র, বিএডিসি, রাঙামাটি শিশুনিকেতন, মহানগর আবাসিক স্কুল, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের নবনির্মিত ছাত্রাবাস, রাঙামাটি জিমনেসিয়াম, রাঙামাটি মারী স্টেডিয়ামের ড্রেসিং রুমসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আশ্রয়শিবিরে থাকা মানুষজনের জন্য ১ কোটি টাকা ও ৬০০ মেট্রিক টন চাল মজুদ রয়েছে বলেও জানা গেছে।

সম্প্রতি রাঙামাটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রে জন্ম নেওয়া এক শিশুকে নিয়ে মেঝেতে শুয়ে আছেন মা। কাপড়সহ নানা আসবাবপত্র এলোমেলোভাবে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। সেখানে মশা-মাছি আর বিড়ালের দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্য করা গেছে। পরিবারের সদস্যরা জানান, পাহাড়ি দুর্যোগের মধ্যেই আশ্রয়কেন্দ্রে জন্ম হয় শিশুটির। এ নিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের। একই কক্ষে অন্য নারী-পুরুষও থাকছেন। মা ও শিশুকে স্বাভাবিক সেবা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ওই পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘আমরা সরকারকেও দোষারোপ করছি না। কিন্তু এখানে এসে বুঝতে পারছি, আশ্রয়কেন্দ্র আর নিজের বসতবাড়ি কখনোই এক হতে পারে না। শুধু খাবার আর ঘুমানো ছাড়া সবই নিজেদের করতে হয়।’ অবশ্য সাময়িক চিকিৎসাসেবা পাওয়ার কথাও জানান তিনি। পাশেই আশ্রয়কেন্দ্রের ছোট একটি কক্ষে অন্তত ১৫ জন বিছানা পেতে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। রাঙামাটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র আশ্রয় নেওয়া মো. কাউসার বলেন, ‘আমাদের কাছে দুটি বাচ্চা আছে, যাদের বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। সর্বনাশা পাহাড় তাদের কেড়ে নিয়েছে। আমি সম্পর্কে ওই দুই বাচ্চার চাচা হই। কিন্তু আমাদেরও কোনো ঘরবাড়ি নেই। পাহাড় সবই কেড়ে নিয়েছে। এখন এই এতিম দুই বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব, কার কাছে যাব।’ তিনি বলেন, তাদের মধ্যে সুমাইয়ার বয়স মাত্র ১৭ মাস। আর মিমের বয়স ছয় বছর। এরই মধ্যে সুমাইয়া অসুস্থ হয়ে পড়েছে। টিভি সেন্টার কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া বিন্দু লাল চাকমা বলেন, ‘বেশ কয়েক দিন ধরেই আশ্রয়কেন্দ্রে সময় কাটছে। জানি না নিজের বসতভিটায় ফিরতে পারব কি না। এখানে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছি।’

এদিকে রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ করেছে জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ১ হাজার ২৩১টি। আর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৫৩৭ বাড়িঘর। আশ্রিতদের ৩ হাজার টাকা ও তিনবান টিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল জেলা প্রশাসনের। ক্ষতিগ্রস্তদের তা এখনো দেওয়া হয়নি। তবে পুনর্বাসনের এখনো অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি বলেও জানা গেছে। জেলা প্রশাসন জানায়, পাহাড় ধসের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বা বিধ্বস্ত ভিটায় এবং পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়িঘর বা স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ জানমাল রক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন তাদের সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পুনর্বাসনের আগে যত দিন তারা সেখানে থাকবেন, তত দিনই তাদের খাবার ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। তবে জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বসতবাড়ি তৈরি করা যাবে না। এ নিয়ে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে। তবে আশ্রিতদের কবে কোথায় পুনর্বাসন করা হবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’

স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আশ্রিতদের জন্য খাবারসহ নিরাপদ পানি সরবরাহ, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। এসব সার্বক্ষণিক তদারক করছে জেলা প্রশাসন। আশ্রয়শিবিরে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে কোনো সাহায্য প্রদান করতে দেওয়া হচ্ছে না। যারা সহযোগিতা করতে চান, তাদের জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর