রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্যায় দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে

নৌকা দেখলেই ছুটে আসছেন দুর্গতরা

প্রতিদিন ডেস্ক

বন্যায় দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে

গলা পর্যন্ত পানি ভেঙে শিশু বাচ্চাকে নিয়ে ত্রাণের আশায় এক নারী। কুড়িগ্রামের উলিপুরে বালাডোবা চর এলাকা থেকে গতকাল তোলা ছবি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

যমুনা ও পদ্মা নদীর কোথাও কোথাও পানি বাড়লেও দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। অনেক স্থানে পানি নামতে থাকার খবর পাওয়া গেছে। তবে বন্যা দুর্গতদের দুর্ভোগ না কমে বরং তা বেড়েই চলেছে। তারা খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবসহ রোগ-বালাইয়ে দিশাহারা অবস্থায় রয়েছেন। কোথাও কোথাও নদীতে নৌকা দেখলেই তারা ত্রাণের আশায় দলে দলে ছুটে আসছেন। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি সামান্য হ্রাস পেলেও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে দীর্ঘদিন ঘর-বাড়ি তলিয়ে থাকায় দুর্ভোগ বেড়েছে চরাঞ্চলের মানুষের। এসব জায়গায় চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। নৌকা বা নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ শুনলেই ত্রাণের জন্য ছুটে আসছেন বানভাসি মানুষজন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার দুই শতাধিক চর ও দ্বীপচরের বানভাসি মানুষজন ১০ দিন ধরে পানিবন্দী থাকায় তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছেন তারা। ফলে সাত উপজেলার ৪২ ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক গ্রামের প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেক বানভাসি পরিবার ঘরের ভিতর উঁচু মাচান বেঁধে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে। পাঠদান বন্ধ রয়েছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসাসহ ১৯৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। গতকাল বিকালে উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বালাডোবা চরের আরমান আলীর স্ত্রী সাহেদা বেগম জানান, সকাল থেকে এখনো রান্না করা হয়নি। ঘরে চাল নেই। তিনি জানান, তার স্বামী বাকিতে চাল কিনতে বাজারে গেছে। চাল না পেলে না খেয়ে থাকতে হবে। নৌকা দেখে কলার ভেলায় শিশু বাচ্চাকে নিয়ে ছুটে আসা একই চরের আরেক বাসিন্দা মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম বলেন, ১০ দিন ধরে পানিবন্দী আছি। স্বামী কাজে যেতে পারে না, কোথাও কাজ নাই। আপনাদের নৌকা দেখে মনে হলো ত্রাণের নৌকা এসেছে। এ জন্য এসে দেখি আপনারা ত্রাণ নিয়া আসেন নাই। ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়া ভেলার ওপর দিন পার করছি। জানা গেছে, এই বালাডোবা চরের শুধু সাহেদা ও আনোয়ারা বেগম নয়— এ অবস্থা এখন এ চরের আকলিমা, মাজেদা, জেসমিন, রাশিদাসহ প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের। সাংবাদিকের নৌকা চরের কাছে ভিরতেই ত্রাণের আশায় কলা গাছের ভেলা ও গলাপানি ভেঙে ছুটে আসতে থাকেন বানভাসিরা। পরে নৌকায় কোনো সাহায্য নেই দেখে হতাশ হয়ে ফিরে যান তারা। বন্যা দুর্গতরা অভিযোগ করেন, এই চরে এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য পৌঁছায়নি। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ১০ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদীর পানি কমে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি কমতে শুরু করায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পানি কমতে শুরু করায় নিজ ঠিকানায় ফিরছেন বন্যাকবলিত মানুষগুলো। তবে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা-ধরলায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। গত সাত দিনে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ জেলায় পাঁচ শতাধিক বসত বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে কয়েকটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তাদের পুনর্বাসন নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। ভেবে পাচ্ছে না কীভাবে ঠিক হবে তাদের ভাঙা বসতবাড়ি। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় লালমনিরহাটে বন্যা দুর্গত মানুষ তাদের বাড়িঘরে ফিরে দেখছেন ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘরে এবং ভিটাতে পলি জমেছে। হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান রেজ্জাকুল ইসলাম কায়েদ জানান, নদী ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। পাটিকাপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শফিউল আলম রোকন জানান, তার ইউনিয়নে বুধবার বিকালে পশ্চিম হলদিবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিস্তা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া চার দিনে তার ইউনিয়নে ২৬টি বসত বাড়িসহ অনেক আবাদি জমি নদী গর্ভে চলে গেছে। আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী জানান, তার ইউনিয়নে গোবর্দ্ধন স্প্যার বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু বাড়ি-ঘর এরই মধ্যে নদী গর্ভে চলে গেছে। লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী জানান, ধরলা নদীর তীরবর্তী শহর রক্ষা বাঁধটি হুমকির মুখে রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত শীবের কুঠি ও চর শীবের কুঠি এলাকায় আবাদি জমিসহ বসত বাড়ি ধরলা নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। তবে জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ আলাউদ্দিন খান জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকেই পুনর্বাসন করা হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজও চলছে। সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল থাকলেও পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ৫টি উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নের প্রায় ৪৮ হাজার পরিবারের তিন লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দী হয়ে আছেন। ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো গরু-ছাগলের সঙ্গে একঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পানিবন্দী মানুষের মাঝে জেলা প্রশাসন থেকে ৩১৮ মেট্রিক টন চাল ও নগদ নয় লাখ টাকা বিতরণ করেছে। কিন্তু বাহুকা, শুভগাছা, খোকশাবাড়ী ইউপির শৈলাবাড়ী ও ব্রাহ্মণবয়ড়ায় ত্রাণ বিতরণ করা হলেও অনেক পরিবার বঞ্চিত রয়েছেন। এসব মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। শুভগাছার টুটুলের মোড় ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেওয়া প্রতিবন্ধী হাসনাহেনা বলেন, ‘বন্যার কারণে বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই চাল ও টাকা পেয়েছে। কিন্তু আমার বসত বাড়িও পানিতে তলিয়ে গেলেও এখনো ত্রাণ পাইনি।’ তার মতো একই অভিযোগ অনেক পরিবারের। ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেওয়া মানুষের টয়লেট ব্যবস্থা ও বিশুদ্ধ পানির সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে। আর সার্বক্ষণিক পানিতে চলাফেরা করায় পানিবন্দী অনেক মানুষের হাতে ঘাসহ পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি গতকাল কমতে শুরু করায় গাইবান্ধার চারটি উপজেলার সার্বিক বন্যার পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। তবে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গো-ঘাট এলাকার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গত চার দিনে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িসহ অন্তত ৭০টি পরিবারের কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, প্রাইমারি স্কুল, কবরস্থান, মসজিদ ভেঙে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া সংস্কারের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বন্যার হাত থেকে মানুষের সহায় সম্বল রক্ষার বাঁধ মরণফাঁদে পরিণত হওয়ার শঙ্কায় দিন পার করছেন নদী তীরবর্তী মানুষ। আসন্ন বন্যায় এসব বাঁধ নিয়ে আতঙ্কে আছেন খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরাও। গত শুক্রবার দুপুর ও রাতে দুবার জেলার সিংড়া রতনপুর বাঁধে গর্ত দিয়ে পানি বের হতে থাকে। ফলে বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার আতঙ্কে পড়েন স্থানীয়রা। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালু ও মাটির বস্তা ফেলে গর্তগুলো মেরামত করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী চন্দ্র শেখর জানায়, ব্রহ্মপুত্রের পানি ৭ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৫১ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের পানি ১২ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমার নিচে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ১৯৬২ সালে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি থেকে পাবনা জেলার বেড়া পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের ডান তীরে নির্মাণ করা হয় ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। গাইবান্ধার ফুলছড়ি থেকে সুন্দরগঞ্জ পর্যন্ত বাঁধটির ৭৮ কিলোমিটার অংশের পুরোটাই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নির্মাণের পর এই বাঁধে এক কোদাল মাটিও দেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রতি বছর বন্যা, বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্থানীয়রা ইচ্ছেমতো বাঁধ কেটে বসতি গড়ে তোলায় এর করুণ দশা হয়েছে। জামালপুর : জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি কিছুটা কমেছে। গেল ২৪ ঘণ্টায় বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি ৮ সেন্টিমিটার কমে গতকাল সকালে বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শুক্রবার একই পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। ২৪ ঘণ্টায় পানি কমেছে ৮ সেন্টিমিটার।

জানা গেছে, পানি কিছুটা কমলেও বন্যা দুর্গত এলাকার পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। ঘরে খাবার নেই, কাজ নেই, নেই বিশুদ্ধ পানি। তার ওপর পানিবাহিত নানা রোগ অসহায় করে তুলেছে তাদের। বিশেষ করে বন্যা কবলিত এলাকায় ভাইরাস জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে।

সিলেট : সিলেটের আটটি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ বন্যার দুর্ভোগে বন্দী রয়েছেন। পানিবন্দী হয়ে থাকা মানুষের মধ্যে রোগব্যাধি বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া বন্যাদুর্গত এসব এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যেও দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে আছে। অনেক এলাকাতেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ত্রাণের দেখা পাননি। ঘরে থাকা খাবার ফুরিয়ে গিয়ে দেখা দিচ্ছে খাদ্য সংকট। কাজ না থাকায় দুর্গত মানুষ আছেন শঙ্কায়। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় গয়াসী গ্রামের অরুণা বিশ্বাস বলেন, ‘এতটা দিন ধরে পানিবন্দী হয়ে আছি। ঘরে খাবার ফুরিয়ে গেছে। কাজ না থাকায় আমাদের সামনে এখন চরম দুঃসময়।’ জানা গেছে, বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে রোগব্যাধির প্রকোপও বাড়ছে। জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, পেটব্যথাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। এ ছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলার প্রধান প্রধান সব বাজার পানিতে তলিয়ে থাকায় এসব এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার বণিক সমিতির আহ্বায়ক আবদুল বারী জানান, বাজারের পাঁচ শতাধিক দোকান পানির নিচে তলিয়ে আছে। এতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি একদিন উন্নতি হলে আরেক দিন অবনতি ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে পাহাড়ি ঢল আসা বন্ধ হলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

সর্বশেষ খবর