রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

জাতীয় কবির ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

জাতীয় কবির ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

আজ ১২ ভাদ্র। দ্রোহ, প্রেম, চেতনার কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (তৎকালীন পিজি) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বঙ্গাব্দ ১৩৮৩-এর আজকের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একটি গানে তিনি লিখেছেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন  গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’। কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক, সৈনিক ও সাংবাদিক। নজরুলের কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ আর  ধূমকেতুর মতো ছিল তার প্রকাশ। বঙ্গাব্দ ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তার ডাক নাম  দুখু মিয়া। মাত্র নয় বছর বয়সে পিতৃহারা হওয়ার পর নজরুলের শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়। আর মাত্র দশ বছর বয়সেই জীবন ও জীবিকার তাগিদে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং  মুয়াজ্জিনের কাজ শুরু করেন নজরুল।  এরপর একটি লেটো গানের দলে যোগ দেন। লেটেরা দলে যোগ দিয়ে সাহিত্যচর্চাও অব্যাহত রাখেন। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে  পেশা হিসেবে বেছে নেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মতো কবিতা; ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। জেলে বন্দী হওয়ার পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দি, এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হলো ইসলামী সংগীত তথা গজল। এর পাশাপাশি তিনি অনেক উত্কৃষ্ট শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। প্রায় ৩ হাজার গান রচনার পাশাপাশি সেগুলোর অধিকাংশের সুরারোপও করেছেন নজরুল। যেগুলো পরবর্তীতে নজরুল সংগীত বা নজরুলগীতি নামে পরিচিতি পায় এবং বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাসকালেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়।  মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় নজরুলের বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহর?রম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্?দম্ ইত্যাদি। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্?, আফজালুল হক প্রমুখের সঙ্গে কবির পরিচয় ঘটে। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শিশির ভাদুড়ী, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সঙ্গে। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল।

১৯২০ সালের ১২ জুলাই ‘নবযুগ’ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন নজরুল। ১৯২১ সালে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন কবি। আর সেখানেই পরিচয় থেকে পরিণয়ে আবদ্ধ হন প্রমীলা দেবীর সঙ্গে। তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নি নার্গিস খানমের সঙ্গে। সেখানে তার আকদও সম্পন্ন হয়। বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। ১৯২২ সালে ১২ আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ একই বছরের ২৩ নভেম্বর নজরুলের যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর কবিকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ  প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দি নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুল যখন আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ সালের ২২ জানুয়ারি) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।

১৯৪২ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন নজরুল। আর ওই বছরের শেষ দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে কবিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। আজ নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করবে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

সর্বশেষ খবর