শিরোনাম
সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

কর্মসংস্থান উল্টোপথে

সরকারকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের তুলনামূলক তথ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে কর্মসংস্থানের ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকলেও ২০১০ সালের পর থেকে তা কমে আসছে।

চাকরি সংস্থানের এই নেতিবাচক প্রবণতা অকৃষি খাত থেকে শুরু করে উৎপাদনমুখী শ্রমঘন খাতেও বজায় রয়েছে জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গার্মেন্ট শিল্পে প্রতিবছর যেখানে ৩ লাখ ২০ হাজার শ্রমিক চাকরিতে ঢুকেছে, সেখানে ২০১০ সালের পর সেটি কমতে কমতে বছরে ৬৪ হাজারে নেমে এসেছে।

সংস্থাটি আরও বলছে, তৈরি পোশাকের পর বাংলাদেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং ওষুধ শিল্পের রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।  কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টির উৎস হিসেবে এই খাতগুলো যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ, দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতিতে তৈরি পোশাক খাত যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছে সেভাবে অন্যান্য খাত পায়নি।

বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি কিমিয়াও ফান গত ১৬ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি পাঠান। কর্মসংস্থান ইস্যুতে নীতি সহায়তার বিষয়ে গত ২৩ জুলাই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন কিমিয়াও ফান। ওই বৈঠকে কর্মসংস্থান বাড়াতে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সরকারকে ‘উন্নয়ন নীতি ঋণ’ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়।  সেপ্টেম্বরে আবারও এ নিয়ে আলোচনার আগে অর্থমন্ত্রীর কাছে এই প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়। ‘বাংলাদেশ : প্রপোসড ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিটস ফর মোর, বেটার, অ্যান্ড ইনক্লুসিভ জব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ২০০৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে প্রভাব রেখেছে গতিশীল চাকরির বাজার, কাঠামোগত পরিবর্তন এবং ব্যাপক উৎপাদনশীলতা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ধারা সুস্পষ্টভাবে নিচের দিকে নেমে এসেছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এ সময় কর্মক্ষম (১৫ বছরের বেশি) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। দেখা যাচ্ছে আলোচ্য সময়ে যে হারে কর্মক্ষম জনশক্তি বেড়েছে কর্মসংস্থান বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে। অপরদিকে ২০১০ সাল থেকে পরবর্তী সময়গুলোতে কর্মসংস্থানের এই গতি উল্টোপথে ধাবিত হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আগের চেয়ে বাড়লেও কর্মসংস্থানের হার ব্যাপকভাবে কমেছে। আলোচ্য সময়ে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। কর্মক্ষম জনশক্তি বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ। এর বিপরীতে কর্মসংস্থানের হার ছিল বছরে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। উপরের তথ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চাকরি সৃষ্টির সম্ভাবনাগুলো শহরের অবকাঠামো ঘাটতি মোকাবিলার ওপরও নির্ভর করে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ লোকের বসবাস এখন ঢাকায়, শিল্পখাতের ৪৫ শতাংশ এবং সেবা খাতের ৩৭ শতাংশ কর্মসংস্থান এখানে। জমির সীমাবদ্ধতার কারণে দেশের সব অংশে নতুন বিনিয়োগ সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে ২য় পর্যায়ের শহরগুলোও বিনিয়োগের বিকল্প স্থান হয়ে উঠতে পারেনি। পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে অবকাঠামোগত সমস্যা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় ঘাটতি দক্ষ শ্রম শক্তি আকর্ষণে ভূমিকা রাখতে পারছে না। দেশে শ্রম শক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিনা বেতনে এবং কৃষি খাতের কাজে যুক্ত উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র ২২ শতাংশ পুরুষ এবং ২০ শতাংশ কর্মজীবী নারী বেতনভুক্ত। পাশাপাশি পুরুষদের একটি বড় অংশ দৈনিক মজুরিভিত্তিতে এবং নারীদের একটি বড় অংশ বিনা বেতনে কাজ করে।  দেশের মোট বেতনভুক্ত কর্মজীবীদের ৪০ শতাংশের কম যাদের চাকরি সম্পর্কিত লিখিত চুক্তি রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা বীমা সুবিধা ও পেনশন পেতে পারেন। প্রতিবেদনে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ে বলা হয়, গত দশকে প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখের বেশি জনশক্তি অস্থায়ী ভিত্তিতে বিদেশে কাজ করতে গিয়েছে, যার মধ্যে নারীও রয়েছে। ২০১৬ সালে বিদেশে মোট জনশক্তি রপ্তানির ১৬ শতাংশ ছিল নারী কর্মী। তবে এ খাতে অনেক চ্যালেঞ্জেও রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চাকরির জন্য বিদেশে যেতে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হয়, যা অন্যান্য দেশে কম। বিদেশে যাওয়া বেশিরভাগ পুরুষকর্মী নির্মাণকাজে এবং নারীকর্মী গার্হস্থ কাজে নিয়োজিত। শ্রম অধিকার ও আত্মরক্ষার বিশেষ ধারাগুলো সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অনেক পুরুষ কর্মী বিদেশে তাদের কর্মক্ষেত্রে নির্যাতিত হচ্ছেন, আর নারীরা হচ্ছেন যৌন নির্যাতনের শিকার। এ অবস্থায় দ্রুত কর্মসংস্থান তৈরি করতে সরকারের নীতির সংস্কার, তৈরি পোশাক খাতের বাইরের খাত (নন আরএমজি) এবং এসএমই খাতে কাঠামোগত রূপান্তর ত্বরান্বিত করার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যে নীতি পর্যালোচনা এবং প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার যে ধরনের শিল্পকে সুরক্ষা দিচ্ছে সেগুলো দেশীয় বা অভ্যন্তরীণ চাহিদানির্ভর শিল্প। এসব শিল্প তেমন শ্রমঘন নয়। ফলে এরা তেমন কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতেও পারছে না। আবার শ্রমঘন খাতও অটোমেশনের মাধ্যমে শ্রম নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠছে। এর ফলে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে বাণিজ্যনীতির সংস্কার করতে হবে। দেশে গার্মেন্ট শিল্পের বাইরে রপ্তানিমুখী যে শ্রমঘন খাত রয়েছে সেগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর