শিরোনাম
সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

দেশে অসময়ে অতি বন্যা যে কারণে

সাখাওয়াত কাওসার

এবারের বন্যা গত কয়েক দশকের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। দেশের প্রায় অর্ধেক জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে গেছে। পানি নামতে শুরু করলেও এখনো লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখনই নিরূপণ করা না গেলেও পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

স্বাভাবিক সময়ে বন্যা হলেও অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টি হওয়ায় এবারের বন্যা পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবার দেশে বন্যা পরিস্থিতির এ অবস্থা হয়েছে বলে মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বর্তমান বন্যা স্বাভাবিক সময়ে হলেও দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় যা ঘটেছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। দিনাজপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, গত ৩০ বছরে এমন পরিস্থিতি তারা দেখেননি। অন্যদিকে হাওরেও এ বছর যে বন্যা হয়েছে, তা ছিল অস্বাভাবিক। কারণ যে বন্যা জুলাইয়ে হয়, তা এবার হয়েছে এপ্রিলে। অন্যদিকে যে পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ার কথা, বৃষ্টিও হয়েছে এর চেয়ে অনেক বেশি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডা. আতিক রহমান বলেন, এবারের বন্যার কিছু জায়গা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দিনাজপুরের বিষয়টা লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, ওখানে গত কয়েক দশকের চেয়ে বৃষ্টিপাত ও পানিপ্রবাহ অনেক বেশি ছিল, যা ওখানকার মানুষের মুখেও উঠে এসেছে। তিনি বলেন, প্রতিবার জুলাই মাসে হাওরাঞ্চলে বন্যা হয়। এবার তা এপ্রিলে লক্ষ্য করা গেছে। একই সঙ্গে অন্যবারের তুলনায় এবার সেখানে বৃষ্টিও প্রচুর হয়েছে। এখানে যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে তা পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে। হাওরের বন্যায় বোরোর ক্ষতির পর এবার আমন ও আউশে বড় ধাক্কা লেগেছে। বোরো মৌসুমে শুধু হাওরের ফসল ডুবে নষ্ট হয়েছিল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বোরো মৌসুমে হাওরে ১০ লাখ টন চাল কম হয়েছিল। আর এবার দেশের উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে মাঠের ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ধানের সঙ্গে ডুবেছে সবজিও। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ৪০ জেলায় ৬ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৪ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবার এ অঞ্চলে অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। চলমান যে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এর পেছনেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেকাংশে দায়ী। এর আগে হাওরের বন্যা পরিস্থিতির জন্যও জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন তারা। তাদের দাবি, এ বন্যার আগে এপ্রিলে হাওরাঞ্চলেও ছিল এর প্রভাব। প্রতিবার জুলাই থেকে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হলেও এবার তা দুই মাস আগেই হয়েছে। এ ছাড়া এবার স্বাভাবিকের চেয়ে ১১৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্মের সদস্যসচিব আনিসুল ইসলাম জানান, হাওরে কাজ করার ক্ষেত্রে তার প্রায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি এবারের মতো এত বড় বিপর্যয় আগে দেখেননি। বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার মাঠপর্যায়ের জরিপে দেখা গেছে, অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় গড়ে ৭৫ ভাগ ফসল তলিয়ে গেছে। এতে ২২ লাখ টন ধান হারিয়েছেন হাওরের কৃষক। ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় দুই হাজার টন মাছ এবং ৩০ হাজার হাঁস মারা গেছে। প্রায় এক হাজার টন সবজি নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, বন্যা পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দেশের ৬৪টির মধ্যে ৩২ জেলার ১৯৯টি উপজেলা ও ৫১টি পৌরসভা বন্যাকবলিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাঙামাটি, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজবাড়ী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, যশোর, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নাটোর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ঢাকা ও শেরপুর জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ এ দফায় বন্যার কবলে পড়েছে। জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে ১৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুরে ৩০ জন, নীলফামারীতে ৬, লালমনিরহাটে ৬, কুড়িগ্রামে ২৩, ঠাকুরগাঁওয়ে ১, গাইবান্ধায় ১৩, বগুড়ায় ৪, সিরাজগঞ্জে ৬, জামালপুরে ১৪, সুনামগঞ্জে ২, নেত্রকোনায় ৪, যশোরে ৩, টাঙ্গাইলে ২, শেরপুরে ৪, মৌলভীবাজারে ২, নওগাঁয় ৬, কুমিল্লায় ২, রংপুরে ৬, মানিকগঞ্জে ১ ও জয়পুরহাটে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বানের পানিতে ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৬২ হেক্টর ফসলি জমি এবং ৪ হাজার ২৮৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্গত জেলাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬১ হাজার ১০৮টি টিউবওয়েল এবং ৫০টি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। এ ছাড়া ৩৭৮ কিমি বাঁধ এবং ৪৪৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২১ জেলায় রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার ১৩০ কিলোমিটার। সরকারি সূত্রগুলো জানায়, জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে।

সরকারের পদক্ষেপের জন্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলায় ২০০৯ সালে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন’ করে। এ ছাড়া বাংলাদেশই প্রথম দেশ, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান অব ২০০৯’ শিরোনামে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে কাজ শুরু করে। বৃক্ষরোপণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে পরিবেশ ও বায়ুদূষণ রোধে। সরকার রাজস্ব বাজেট থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর