বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

পুরান ঢাকায় বানরের অভয়াশ্রম

মাহবুব মমতাজী

পুরান ঢাকায় বানরের অভয়াশ্রম

পুরান ঢাকার ‘গ্র্যান্ড এরিয়া’ খ্যাত স্থানটি এখন ‘গেন্ডারিয়া’ নামে পরিচিত। এ এলাকার দীননাথ সেন রোডে অবস্থিত সাধনা ঔষধালয়। যেখান থেকে ঢাকায় বানরের বিস্তার। ১৯১৪ সাল থেকে সাধনার চত্বরকে বানরের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ডা. যোগেশ চন্দ্র ঘোষ। তিনি নিজস্ব ছাপাখানার ওপরের একটি কক্ষ বানরের বিশ্রামখানা হিসেবে ছেড়ে দেন। সেই সঙ্গে সকাল-বিকাল খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তার ছেলে নরেশ চন্দ্র ঘোষ ও নাতি প্রদীপ চন্দ্র ঘোষ পূর্বপুরুষের এই ধারা বজায় রেখেছেন। দীর্ঘ শতাধিক বছর ধরে এ নিয়ম চালু রেখেছে সাধনা কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৭ সাল থেকে সাধনায় কর্মরত আছেন নারায়ণ চন্দ্র চক্রবর্তী। এই সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বানরের খাবার দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত এক দিনের জন্যও তা বন্ধ করা হয়নি।’ নিরাপত্তাকর্মী সুবীর দাস বলেন, ‘বানরের খাবারের জন্য সকালে ছোলা দেওয়া হয়। খাবার সংকটের কারণে বানরের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। তারা খাবারের সন্ধানে সাধনা ছেড়ে অন্য বাসাবাড়িতে চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো বানর লাফালাফি করে বিদ্যুতে শক খেয়ে মারা যায়। বর্তমানে এর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় শতে।’ ধোলাইপাড়ের যশোধন প্রামাণিক। তিনি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বানর পালছেন। সাংবাদিক শিব শঙ্কর চক্রবর্তীর সহযোগিতায় তাদের খাবার দেওয়া শুরু করেন। প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঢাকার বেশির ভাগ স্মৃতি হারিয়ে গেলেও টিকে আছে শুধু বানর। গেন্ডারিয়া, মিল ব্যারাক, বনগ্রাম, মৈশুণ্ডি, জনসন রোড, নবাবপুরের রথখোলা, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, সূত্রাপুর, স্বামীবাগ এলাকায় এক দালান থেকে আরেক দালানে বানরগুলোর লাফিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সহজেই পথচারীর চোখে পড়ে। পুরান ঢাকার বাসিন্দা শ্রীকান্ত সাহা জানান, ‘একসময় স্বামীবাগের শক্তি ঔষধালয়, সাধনা ঔষধালয়সহ বেশকিছু মঠ-মন্দির-আশ্রম কর্তৃপক্ষ বানরের জন্য নিয়মিত খাবার সরবরাহ করত। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে সাধনা ঔষধালয় আজও ব্যতিক্রম। তারা এই মহৎ কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে।’ বানরের এই অস্তিত্ব সংকটে অনেকে হতাশা প্রকাশও করেছেন। তাদের মধ্যে ময়েজউদ্দিন জানান, ‘ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি জীবজন্তু আর গাছপালায় ভরা পুরান ঢাকা। গুইসাপ, বেজি, আরজিনা, সাপ, কাঠবিড়ালি কত শত প্রাণী ছিল। হিন্দুরা পশুপাখিকে যেমন খেতে দিত, বানরকে রামের বাহন ভেবে বেশ যত্ন করত। ঢাকার বাইরে থেকে নদীভাঙা লোকজন আসার পর প্রাণীগুলো মারা পড়তে থাকে।’

জানা গেছে, খাদ্য সংকটের কারণে বিভিন্ন বাসাবাড়ি, প্রতিষ্ঠান কিংবা দোকানে হামলা করে বানরগুলো। কলা, রুটি কিংবা ভাতের ভাণ্ড ছাদে চলে যায় তারা। আবার খাবার না পেয়ে অনেক সময় কামড় দেয় মানুষকে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে কাঠবিড়ালি ও সলিমুল্লাহ হলে বানর দল বেঁধে বিচরণ করত। কিন্তু পুরনো ভবন ভেঙে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ ও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের কারণে বানর হারিয়ে যেতে থাকে। আজ আর এই এলাকায় বানরের দেখা মেলে না। দীননাথ সেন রোডের বাসিন্দা সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের মনুষ্যত্বহীনতার কারণে প্রায় প্রতিদিনই পুরান ঢাকা থেকে দু-চারটি করে বানর হারিয়ে যাচ্ছে।’ প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেন, মাদারীপুরের চরমুগুরিয়া, যশোরের কেশবপুর ও গাজীপুরের বর্মী এলাকায় নানা প্রজাতির বানর পাওয়া গেলেও পুরান ঢাকায় শুধু ‘রেসাস’ জাতের বানর দেখা যায়। দেশে হনুমান ও উল্লুক ছাড়া বানর রয়েছে পাঁচ প্রজাতির। তবে রেসাস ও ম্যাকাকু প্রজাতির বানরের ডিএনএর গঠন মানুষের খুব কাছাকাছি। তাই গবেষকদের কাছে পুরান ঢাকার বানর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুরান ঢাকাবাসীর ভালোবাসাই বানরকুল রক্ষা করতে পারে। এজন্য সাধনার পাশাপাশি বলধা গার্ডেনকেও বানরের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলা দরকার।

সর্বশেষ খবর