শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রূপার লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর

নিজস্ব প্রতিবেদক ও সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে দাফনের চার দিন পর চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার জাকিয়া সুলতানা রূপার শেষ পর্যন্ত  ঠাঁই হচ্ছে নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানে। গতকাল বিকালে টাঙ্গাইলের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম গোলাম কিবরিয়ার আদেশে লাশটি কবর থেকে তুলে তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সন্ধ্যার পর সিরাজগঞ্জের তাড়াশে লাশ পুনরায় দাফন হয়।

সন্ধ্যার আগে টাঙ্গাইলের মধুপুর কবরস্থান থেকে রূপার লাশ উত্তোলনের পর অ্যাম্বুলেন্সযোগে গ্রামে পৌঁছলে আদরের মেয়েকে দেখার জন্য ছুটে যান গর্ভধারিণী মা, ভাই-বোন ও স্বজনরা। কিন্তু সাত দিন আগে মারা যাওয়ায় রূপার শরীরে পচন ধরায় কফিন খোলা সম্ভব হয় না। তাই কফিন জড়িয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না তাদের। আদরের মেয়েহারা মা ও বড় বোনহারা ছোটবোনদের বুকফাটা আহাজারি দেখে এলাকাবাসীর চোখেও ঝরতে শুরু করে অশ্রু। এর পরও কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে সবার একটাই দাবি উচ্চারিত হয়— রূপার হত্যাকারীরা যেন আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে না যায় এবং খুনিদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। রূপার মায়ের দাবি, ‘মেয়ের খুনিদের বিচার দেখে মরতে চাই।’

মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম জানান, টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সদর উপজেলার ভূমি কর্মকর্তা আবদুর রহিম সুজনের উপস্থিতিতে লাশ উত্তোলন করা হয়। এর আগে রূপার পরিবারের পক্ষ থেকে লাশ চেয়ে মধুপুর থানায় আবেদন করা হলে পুলিশ সে আবেদন আদালতে পাঠায়। টাঙ্গাইলের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম গোলাম কিবরিয়া লাশ কবর থেকে তুলে রূপার পরিবারের কাছে হস্তান্তরের আদেশ দেন।

এদিকে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে রূপার মা শুধুই বিলাপ করছেন। তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকতেই খুনিদের বিচার দেখতে চাই।’ রূপার মামা কলেজশিক্ষক শফিউল হক বাবলু সাংবাদিকদের জানান, ‘রূপা বড় অভিমানী ছিল। তার ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মত ব্যক্তিত্ব। শিক্ষায় ছিল সে অদম্য মেধাবী। নিয়মিত নামাজ ও কোরআন পড়ত।’ তিনি বলেন, ‘ভাই-বোনের মধ্যে বেশি অভিমান থাকায় রূপাকে সবাই সমীহ করে চলত। অভাবের কশাঘাত পায়ে ঠেলে রূপা তার ভাই-বোনের শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল।’ মূলত রূপা খাতুনের হাত ধরেই তার ছোট বোন পপি নাটোরের সরকারি কলেজ থেকে স্মাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছোট ভাই উজ্জ্বল প্রামাণিককে শিক্ষিত করে তুলতে তার বেতনের টাকা নিয়মিত তার হাতে দিতেন। শান্ত স্বভাবের মেয়ে রূপার অপ্রাপ্তি নিয়ে হতাশা ছিল না। তিনি ছিলেন মনের দিক থেকে কোমল। পরিবারের সবাই রূপার অভিমানের কথা জানতেন বলে তাকে বেশি আদর করতেন।

রূপার বড় বোন জিয়াসমিন খাতুন ফুলেরা জানান, ‘আকাশছোঁয়া স্বপ্ন ছিল রূপার। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে আইনজীবী হওয়ার।’

তার মামী লাভলী খাতুন বলেন, ‘আইনজীবী হওয়ার পর মামার বাড়িতে আসবে এমন জিদ করে বসেছিল রূপা। কিন্তু নরপশুরা তার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। স্বপ্ন পূরণের আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় দেওয়া হলো তাকে।’

ফুলেরা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রূপার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। আমার অসুখের কথা শুনে বলেছিল, “আপা আমি ছুটি পেলেই তোমাকে রাজশাহী হাসপাতালে নিয়ে যাব। মাকে ভালো ডাক্তার দেখাব।” কিন্তু তা আর হলো না। এখন আমার মাকে, ছোট ভাই-বোনকে দেখার মতো কেউ থাকল না।’

গত শুক্রবার রাতে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে রূপাকে ধর্ষণের পর ঘাড় মটকে হত্যা করা হয়। পরে তার লাশ টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে রাখা হয়। রাতে মধুপুর থানার পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। এরপর শনিবার টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত হয়। ওই দিনই টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা হয়। সোমবার রূপার বড় ভাই হাফিজুল একটি পত্রিকায় বেওয়ারিশ লাশ দাফনের সংবাদ দেখে মধুপুর থানায় এসে বোনের লাশ শনাক্ত করেন। এদিকে এ ঘটনায় ওই বাসের চালক হাবিবুর রহমান, সুপারভাইজার সফর আলী, বাসের তিন হেলপার শামীম, জাহাঙ্গীর ও আকরামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। চলন্ত বাসে ‘ধর্ষণের পর হত্যা’র শিকার জাকিয়া সুলতানা রূপার লাশ কবর থেকে তুলে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর