শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা নিয়ে সতর্ক গোয়েন্দারা

দুই দফায় পুলিশ সদর দফতরের চিঠি ♦ অস্ত্র-জঙ্গি প্রবেশের আশঙ্কা

সাখাওয়াত কাওসার

রোহিঙ্গা নিয়ে সতর্ক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেওয়ার সুযোগে জঙ্গি, মাদক এবং অবৈধ অস্ত্র ঢুকে না পড়ে— এ নিয়ে চিন্তিত গোয়েন্দারা। যে কোনো মূল্যে কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে। এরই মধ্যে দুই দফায় পুলিশ সদর দফতর থেকে দেশের সব কটি রেঞ্জ, মহানগর ও জেলার পুলিশপ্রধানকে এ-সংক্রান্ত বিশেষ নোট পাঠানো হয়েছে। তাতে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দিকে বিশেষ নজর দিতে বলা হয়েছে। বিশ্লেষকরাও বলছেন, রোহিঙ্গা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে না নিলে দেশে বাজে পরিস্থিতির অবতারণা হতে পারে। এ ইস্যুতে কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা তাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। জানা গেছে, বিগত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশক থেকে কক্সবাজার-বান্দরবান এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় মিয়ানমারের অধিবাসী এসব রোহিঙ্গা সরকারি-বেসরকারি নানা সহযোগিতা ও কৌশলে তাদের শক্ত অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গোপনীয়) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সব ধরনের আশঙ্কাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। আর এ বিষয়ে ঈদুল আজহার আগে ও পরে পুলিশ সদর দফতর থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট সব দফতরে।’ নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যু কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। মানবিকতার স্বার্থে যেসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেককে হয়তো ভুল বুঝিয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ফেলার  তৎপরতা চালাতে পারে কুচক্রী মহল। তাই রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপত্তার বোঝা বিষফোঁড়া হয়ে না উঠতে পারে, সেজন্য আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থাকে আরও সতর্ক হতে হবে।’ একাধিক সূত্র বলছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র বেচাকেনা, মাদক পাচার, চোরাকারবারি, ডাকাতি, ধর্ষণ, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িত। এর বাইরে আন্তর্জাতিক মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের এক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মীদের একটা বড় উৎস হলো রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের জঙ্গি কর্মী হিসেবে রিক্রুট করছে। রামুতে বৌদ্ধ বিহারে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সুস্পষ্ট জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করারও যথেষ্ট উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশি পাসপোর্টে বিদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে আটক রোহিঙ্গাদের প্রায় সবাই মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের। বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার জন্য তাদের প্রস্তুতি শুরু হয় মিয়ানমারে থাকতেই। তারা কথা বলে কক্সবাজার অঞ্চলের ভাষায়। শারীরিক গড়ন এবং চেহারাও এখানকার অধিবাসীদের মতো। একে সুযোগ হিসেবে নিয়ে এপারের কিছু দালাল অর্থের বিনিময়ে তাদের সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে পাঠায়। নাগরিকত্ব সনদ থেকে শুরু করে যাবতীয় কাগজপত্র জোগাড়, এমনকি পুলিশি তদন্ত রিপোর্ট পর্যন্ত তারা ম্যানেজ করে। রোহিঙ্গারা এভাবে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে পাড়ি দেয় বিদেশে।

সংঘাতের আশঙ্কা : গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা শুধু কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চলেই তাদের আস্তানা গড়েনি, তারা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়েও বেশ ভিতরে এসে আস্তানা গড়ে তুলেছে। সম্প্রতি যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তারা ইতিমধ্যে কক্সবাজারের প্রায় ৫০০ একর বনাঞ্চল ধ্বংস করে বস্তি গড়ে তুলেছে। আবার স্থানীয় মস্তান ও রোহিঙ্গা নেতাদের নির্দেশে এসব বস্তিতে ঘর তৈরি করতেও তাদের গুনতে হচ্ছে টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন আদিবাসী সংবাদকর্মী ও এলাকার অধিবাসীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এমনিতেই তিন পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের সঙ্গে সেটেলার বাঙালিদের এক ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে আছে, এর ওপর এসব অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা যদি আরও অধিক হারে আদিবাসীদের জায়গাজমিতে দখল নিয়ে বসে, তাহলে আবার আদিবাসীদের সঙ্গে এই রোহিঙ্গাদের এক ধরনের নতুন সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। শুধু কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া নয়; রোহিঙ্গারা বেশ কিছুদিন ধরে বান্দরবানের লামা এলাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে বলে স্থানীয় জনসাধারণ অভিযোগ করেছেন। লামার পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান নিয়েছে রোহিঙ্গারা। স্বার্থ হাসিলে চট্টগ্রাম জেলার দোহাজারী, পটিয়া, বোয়ালখালীর বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় তাদের বসতি স্থাপনের সুযোগ করে দিচ্ছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী লোক। দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোকদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের চেহারার ও ভাষার রয়েছে অনেকটা মিল। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজন এসব এলাকায় বসবাস করায় তারাই রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।

জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ : ‘ইত্তেহাদুল জামিয়াতুল রোহিঙ্গা’ নামে নতুন একটি সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভিতরে বসেই বেশ কৌশলে কাজ করছে রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন। আর এ সংগঠনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের। এ সংগঠনের সভাপতি হাফেজ সালাউল এবং সেক্রেটারি সালামত উল্লাহসহ ১৮ সদস্যের একটি শূরা কমিটি রয়েছে, যার অধিকাংশই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। ইত্তেহাদুল জামিয়াতুল রোহিঙ্গার সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা তোফায়েল। উখিয়া থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংগঠনটিকে পরিচিত করার কাজ করছেন মুহাম্মদ জুবায়ের, যিনি ভারতভিত্তিক সংগঠন ‘বায়তুল মাল ইন্ডিয়া’র নেতা। আর সামরিক শাখার কমান্ডারের দায়িত্বে আছেন মাস্টার আইয়ুব, যিনি আফগান, সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মুখপাত্র ‘আলতাদামুন’ ১৯৯১ সালের আগস্ট সংখ্যায় দেখা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফেডারেশন স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের (আইআইএফএসও) আয়োজনে কক্সবাজারে ১৯৮৯ সালের ১৩ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওই সময়ের সভাপতি আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের (সাবেক এমপি) ও সেক্রেটারি জেনারেল আমিনুল ইসলাম মুকুলের সঙ্গে একই সঙ্গে বৈঠক করছেন আরএসওর প্রতিষ্ঠাতা আমির ড. নুরুল ইসলাম। বাংলাদেশ-মিয়ানমার ছাড়াও ফিলিপাইন, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে এর নেটওয়ার্ক।

জানা গেছে, আরএসও নাম পরিবর্তন করে আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়ন বা আরআরইউ রাখা হয়েছে। ২০১১ সালের ৩০ ও ৩১ মে সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ নামকরণ করা হয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ৩৪ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল মঞ্জুর হাসান বলেন, ‘জঙ্গি, মাদক কিংবা অস্ত্রের বিষয়ে আমরা অনেক বেশি সতর্ক। তবে এখন পর্যন্ত যেসব রোহিঙ্গা দেশে প্রবেশ করেছে, তাদের বেশির ভাগই এক কাপড়ে এসেছে। এর পরও আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর